চট্টগ্রাম: এ ফক্স, লোট্টো থেকে দেশীয় ব্র্যান্ড এপেক্সসহ নামিদামি সব ব্র্যান্ডের জুতো পাওয়া যায় নগরীর ব্যাংক পাড়া খ্যাত আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাতে। কোনোটি নকল কোনোটি আবার আসল।
বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ফুরসত মেলেনা বিক্রেতাদের। সস্তা এবং টেকসই জুতার জন্য নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সবাই আসেন এখানে। তবে সস্তায় কিনে অনেকে প্রতারণারও শিকার হন।
কিন্তু শো-রুমগুলোতে যে জুতো চার-পাঁচ হাজার টাকায়ও মেলেনা সে জুতো এখানে মাত্র হাজার টাকায় পাওয়া যায়। এর কারণ কী?
জানতে চাইলে রিয়াদ নামের এক বিক্রেতা বললেন,‘রপ্তারির জন্য তৈরি জুতো অনেক সময় বিদেশী ক্রেতারা ঠুনকো কারণে রিজেক্ট করে দেয়। রিজেক্ট মালগুলো কারখানা মালিকরা কমদামে বিক্রি করে দেয়। পরে মালগুলো কয়েক হাত ঘুরে ফুটপাতে চলে আসে। যার কারণে এখানে কম দামে পাওয়া যায়। ’
তবে অনেক ব্যবসায়ী এর আড়ালে স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি জুতোতে নামী-দামি ব্র্যান্ডের লোগো কিংবা স্টিকার লাগিয়ে প্রতারণা করেন বলে অকপটে স্বীকার করেন এ ব্যবসায়ী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আগ্রাবাদের ইস্টার্ন ব্যাংকের সামনের ফুটপাত, চট্টগ্রাম চেম্বার, আখতারুজ্জামান সেন্টারসহ আশপাশের পুরো এলাকার ফুটপাত জুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে নানারকম ডিজাইনের জুতার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভাসমান দোকানীরা।
চীন, ভিয়েতনামসহ নানা দেশের কেডস, সেন্ডেলসহ বিভিন্ন স্তুপে নানা ডিজাইনের জুতো রয়েছে এখানে। এরমধ্যে কেডস, চটি, ফরমাল স্যু অন্যতম।
বিক্রেতারা জানান, এই মার্কেটে শুধুমাত্র ছেলেদের জুতো পাওয়া যায়। আর এসব জুতো পাঁচশ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সামনে কেডস ও সেন্ডেলের পসরা নিয়ে বসেছেন ভাসমান দোকানী মো. জাহাঙ্গীর আলম (২৭)। তিনি গত পাঁচ বছর ধরে এখানে জুতোর ব্যবসা করে আসছেন।
তিনি বলেন,‘আমাদের মোটামুটি বিক্রি হয় দুপুর থেকে শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত। এছাড়া বিকালে অফিস ছুটি হওয়ার পর থেকে সন্ধ্যার কিছু পর পর্যন্ত বেশ ভাল বিক্রি হয়। ’
সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরীর সবচেয়ে বড় ভাসমান এই মার্কেটে ঢাকা ও চায়না জুতো বিক্রি হলেও বেশিরভাগ পণ্য আসে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে। সেখানে যেসব জুতো বিদেশি ক্রেতারা নিতে চান না মূলত ওই পণ্যই এখানে বিক্রি হয়। তবে মাঝে মাঝে ভাল ও নিখুঁত জুতোও তারা বিক্রি করেন। অনেক সময় ইপিজেড থেকে চুরি হওয়া জুতোও এখানে বিক্রি হয়।
জাহাঙ্গীর আলম নামে এক বিক্রেতা বলেন,‘দুইটা পার্টির (বিক্রেতা) হাত ঘুরে আমাদের কাছে মালগুলো আসে। এরপর তা আমরা বিক্রি করি। ’
তিনি বলেন, ‘জুতো ভাল এবং শপিংমলের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় বলেই ক্রেতারা আমাদের কাছে বেশি আশে। ’
তার কাছে এপেক্স, লোট্টো ও এ ফক্স ব্র্যান্ডের জুতোও রয়েছে বলে জানান জাহাঙ্গীর।
জানতে চাইলে সিলভারস্পুন রেস্তোরার সামনে বসা দোকানী মো. রাজু বলেন,‘মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরাই বেশি আসে। দশটা দেখে দর দাম করে একটি নিয়ে যায়। ’
এদিকে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে অর্ডার দিলে তারা চাহিদা অনুযায়ী জুতো সরবরাহ করে থাকে বলে জানালেন আগ্রাবাদ ইস্টার্ন ব্যাংকের সামনে বসা দোকানী রিয়াদ (২১)।
তিনি জানান,‘মাল পৌঁছানোর আগেই অর্ডারের সময় অগ্রিম টাকা দিতে হয়। বাকিটা পণ্য পৌঁছে দেয়ার পর শোধ করতে হয়। তবে ইপিজেড থেকে অনেক মালামাল চোরাই কিংবা কারখানার কর্মকর্তারা বিক্রি করেন। ’
রিয়াদ বলেন,‘বিদেশি জুতোর চেয়ে দেশি জুতোয় লাভ বেশি হয়। ইপিজেডের জুতো দীর্ঘদিন টেকসই হয়। এ জন্য কাস্টমারদের কাছে এর চাহিদাও বেশি। ’
এছাড়া চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার (সিইপিজেড) বিভিন্ন কারখানার পন্যের সঙ্গে ইপিজেড ও সংশ্লিষ্ট কারখানার কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন বলে জানান দোকানীরা।
মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, জুতোর সমাহারে ঘুরে ঘুরে পছন্দেরটি কিনতে ব্যস্ত ক্রেতারা। কেউ আবার পরখ করে দেখছেন। তেমনি একজন আগ্রাবাদের একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইমুল হোসেন রুবেল।
তিনি বলেন,‘চাকরি করে যে বেতন পাই, তা দিয়ে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সংসার চালাতে হয়। বিভিন্ন শপিংমল কিংবা শো-রুম থেকে কিনতে গেলে অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। তাই এখানে আসলাম। ’
‘একটু সময় নিয়ে দেখে শুনে কিনলে জিনিসটা ভাল হয়’ যোগ করেন রুবেল।
তবে কমমূল্যের পাশাপাশি এই মার্কেটে নকলের দৌরাত্মও রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কামরুল হাসান বাবর নামে হাইডেল পার্ক সিমেন্টের এক কর্মকর্তা।
তার ভাষায়,‘সাধ্যের মধ্যে জিনিসটা পাওয়া যায়। এটাই হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু বুঝে শুনে না কিনলে পস্তাতে হয়। ’
তিনি জানান, অনেক সময় অখ্যাত ও ছেঁড়া জুতোয় পট্টি কিংবা ভাল ব্রান্ডের স্টিকার অথবা লেবেল দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে বিক্রেতারা। এতে অনেককে-ই ঠকতে হয়।
ব্যবসা জমে উৎসবে:
নগরীর সবচেয়ে বড় এই ভাসমান জুতোর মার্কেটে বেচাকেনা সারাবছর ধরে চললেও জম্পেশ বেচা-বিক্রি জমে উঠে পূজা কিংবা রমজানের ঈদে। এছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়েও নানা উৎসব-পার্বনে ভাল বেচাকেনা হয়।
মো. ইসহাক বলেন,‘ এখন বেচাকেনা খুব একটা হয় না। চলে যাচ্ছে কোনমতে, এরমধ্যে হরতাল-অবরোধও ছিল। তবে রমজান ঈদসহ বিভিন্ন পূজা-পার্বনে আমাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। ’
রয়েছে বিড়ম্বনাও:
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, ফুটপাতে ব্যবসা পরিচালনায় করতে গিয়ে তাদেরকে এলাকার বিভিন্ন নেতাদের চাঁদা থেকে শুরু করে প্রশাসনের লোকজনকেও ম্যানেজ করতে হয়। অনেক সময় এসব চাঁদা নিয়ে তাদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
রহমত উল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী জানালেন, তাদেরকে প্রতিমাসে ১হাজার ৫শ’ করে জায়গার ভাড়া দিতে হয়। প্রতিদিনই জেনারেটরের বিল গুণতে হয় ২০ টাকা। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন নেতাসহ প্রশাসনকেও টাকা দিতে হয়।
আবদুল জলিল নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন,‘চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। সবাইকেই দিতে হয়। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৪