ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সহিংসতায় জামায়াতের অনুসারী বিএনপি

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৪
সহিংসতায় জামায়াতের অনুসারী বিএনপি

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে নাশকতা ও সহিংসতায় জামায়াত-শিবিরকে অনুসরণ করছে বিএনপি। এতদিন ধরে ‘পেট্রল বোমা’, হাতবোমা, ককটেল বানানো এবং রাজনৈতিক কর্মসূচীতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবিরের নাম উঠে এলেও সম্প্রতি নগরীতে হিউম্যান হলারের এক চালককে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় বিএনপির সম্পৃক্ততারও তথ্য পাওয়া গেছে।



নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও নগর ছাত্রদলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক টিংকু দাশের নেতৃত্বে থাকা একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিজেরাই বানাচ্ছে পেট্রল বোমা, ককটেলসহ বিভিন্ন বিস্ফোরক আবার সেগুলো মিছিল-সমাবেশ থেকে বিস্ফোরেণের জন্য তুলে দিচ্ছে কর্মীদের হাতে।

এভাবেই টিংকু দাশসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিকল্পিত সহিংসতার শিকার হয়ে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন মো.মিতুল মিয়া (২২) নামে এক গাড়িচালক।
টিংকু দাশ নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা.শাহাদাৎ হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

মিতুল খুনের ঘটনায় মঙ্গলবার গভীর রাতে কোতয়ালী, পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ থানা পুলিশ যৌথভাবে নগরীর পলিটেকনিক ও হিলভিউ আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে টিংকু দাশের অনুসারী বিএনপির সক্রিয় তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। এরা হল, সুজা মিয়া (৫০), নজরুল ইসলাম (৩০) ও ওসমান গণি (২৯)।

এদের মধ্যে নজরুল ও ওসমান বুধবার বিকেলে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে গাড়িচালক মিতুলের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণণা দেন যাতে উঠে আসে সহিংসতার নেপথ্যের কারিগরদের নামও। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও তারা একই বক্তব্য দিয়েছেন।

নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওসি আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, ‘নজরুল, সুজা ও ওসমান বিএনপির সক্রিয় কর্মী। সবসময় মিছিল-সমাবেশে থাকে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা নিজেরাই পেট্রল বোমা বানায়। নজরুল ও ওসমান গাড়িতে পেট্রল বোমা ছোঁড়ার কথা স্বীকার করেছে। আরও কয়েকজনের নাম তারা জবানবন্দিতে জানিয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা যাবেনা। ’

দশম সংসদ নির্বাচনের পরদিন গত ৬ জানুয়ারি রাতে নগরীর নাসিরাবাদে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এলাকায় হরতাল ও অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করে বিএনপি। মিছিল থেকে লেগুনা নামের একটি হিউম্যান হলারে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে মারলে সেটিতে আগুন ধরে যায় এবং চালক মিতুল মিয়া দগ্ধ হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জানুয়ারি ভোরে মিতুল চমেক হাসপাতালে মারা যান।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে ওসমান গণি নিজেকে বিএনপি সমর্থক দাবি করে জানায়, ৬ জানুয়ারি রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে পলিটেকনিক এলাকায় টিংকু দাশের নেতৃত্বে নির্বাচন বিরোধী একটি মিছিল বের হয়। মিছিলে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মধ্যে আরও ছিলেন হারুন, মামুন, মকবুল ও জমির উদ্দিন। মিছিলে ৭০ জনের মত ছিল। মিছিলে নজরুল, কামাল ও করিমের হাতে ছিল পেট্রল বোমা এবং আসিফ ও জাবেদের হাতে ছিল ককটেল। এসব বিস্ফোরক নিয়ে তারা সেখানে পিকেটিং শুরু করে।

ওসমান জানায়, ওইসময় রাস্তা দিয়ে একটি যাত্রীবিহীন লেগুনা গাড়ি যাচ্ছিল। করিম ও নজরুল লেগুনা লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে মারে। করিমের পেট্রল বোমা চালকের পায়ের কাছে বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। নজরুলের পেট্রল বোমা গাড়ির পেছনে পড়ে সেখানে আগুন ধরে যায়। আসিফ ও জাবেদ রাস্তায় ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতংক সৃষ্টি করে। আর ওসমান ও সুজা মিয়া পলিটকেনিক ইনস্টিটিউটের বাসে ঢিল ছুঁড়ে ভাংচুর করে।

ওসমান জানায়, টিংকু দাশের কর্মী আলাউদ্দিন ও কামাল পেট্রল বোমা এবং ককটেল, হাতবোমা তৈরির কারিগর। তাদের মিছিল-সমাবেশের সিদ্ধান্তের কথা জানালে তারা পেট্রল বোমা-ককটেল সরবরাহ করে। কামালের বাসা নগরীর মাইজপাড়া এলাকায় এবং আলাউদ্দিনের বাসা নগরীর রুবি কলোনিতে।

এদিকে জবানবন্দিতে নজরুল জানায়, নির্বাচনের দিন করিম দু’টি পেট্রল বোমা ওসমানকে দেয়। ওসমান ও নজরুল মিলে পেট্রল বোমা দু’টি পলিটেকনিকের পাশে পাহাড়ে লুকিয়ে রাখে। ৬ জানুয়ারি বিকেলে তারা পেট্রল বোমাগুলো নিয়ে পলিটেকনিক মোড়ে আসে। রাতে মিছিল থেকে করিম লেগুনা গাড়ির সামনে এবং নজরুল পেছনের দিকে পেট্রল বোমাগুলো ছুঁড়ে মারে। লেগুনা গাড়িতে আগুন ধরে গেলে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়। এসময় তারা ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়।

জবানবন্দিতে নজরুল স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে জমির উদ্দিন, নাশিদ, আসিফ, সুজা, করিম, ইউসুফ ও টিটুর নাম উল্লেখ করে জানায়, তারাও মিছিলে ছিল। বিএনপি নেতাদের নির্দেশে মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল বলে এরা নজরুলকে জানিয়েছে বলেও সে জবানবন্দিতে জানায়।

চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আহমেদ সাঈদের আদালতে দেয়া দু’পৃষ্ঠা করে চার পৃষ্ঠার জবানবন্দি প্রদান শেষে ওসমান ও নজরুল উভয়কেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া সুজাকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, টিংকু দাশ ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তৎকালীন নগর ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। নগরীর পাহাড়তলী কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তার নাম শীর্ষ ছাত্রদল ক্যাডার হিসেবে নগর পুলিশের তালিকায় স্থান পায়।

সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে প্রায় এক দশক বিএনপির রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও সম্প্রতি নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা.শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাকে দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে বলে সূত্র জানায়।

এমনকি হরতাল-অবরোধে চোরাগোপ্তা হামলা, ঝটিকা মিছিল করে ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি ভাংচুরসহ বিভিন্ন নাশকতায় টিংকু দাশ ও তার অনুসারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও তথ্য আছে পুলিশের কাছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য নগর বিএনপির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ডা.শাহাদাৎ হোসেনের মোবাইলে ফোন করা হলেও উভয় নেতার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৪
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।