ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কোন জাহাজে এসেছিল, তদন্তে-সাক্ষ্যে মিলেনি জবাব

রমেন দাশগুপ্ত,স্পেশাল করেসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৪
কোন জাহাজে এসেছিল, তদন্তে-সাক্ষ্যে মিলেনি জবাব

চট্টগ্রাম: দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত যে সাতটি পর্যবেক্ষণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কোন জলযানের মাধ্যমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদেশ থেকে আনয়ণ করা হয়েছে তা উদঘাটন। কিন্তু অধিকতর তদন্তে অস্ত্র আনয়ণকারী জাহাজের কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা।

আদালতে দেয়া সাক্ষ্যেও এ বিষয়ে অপারগতার কথা সরাসরি বলেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

রাষ্ট্রপক্ষের দাবি অনুযায়ী অধিকতর তদন্তে আদালতের বাকি ছয় দফা পর্যবেক্ষণের জবাব মিলেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত রহস্য হিসেবে থাকা জাহাজের বিষয়ে আসন্ন রায়ে আদালত কি পর্যবেক্ষণ দেন-তার জন্য এখন রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামীপক্ষের আইনজীবীরা কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, অস্ত্র আনয়ণকারী দেশীয় অথবা বিদেশী জাহাজের তথ্য পাবার চেষ্টা করেছিলেন অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু ঘটনার দীর্ঘসময় পর অধিকতর তদন্ত শুরু হওয়ায় তিনি সম্পূর্ণ তথ্য উদঘাটন করতে পারেননি। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছেন।

অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, আদালত অস্ত্রের উৎস, গন্তব্য, অস্ত্রের ধরণ, চালান থেকে অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল কিনা, কাদের জন্য অস্ত্র আনা হয়েছিল, কোন জলযানে অস্ত্র ঢুকেছিল-এ ধরনের সাতটি প্রশ্ন দেন। আমি ছয়টি প্রশ্নের জবাব প্রমাণসহ দিতে পেরেছি। চার নম্বর যে প্রশ্নটি ছিল জাহাজ সম্পর্কিত সেটির ব্যাপারে তদন্তে কিছু পাইনি। এইচআরসি শিপিংয়ের বঙ্গবোরাক জাহাজে করে অস্ত্র আসার কথা বলা হয়েছিল, তদন্তে সে ধরনের কিছুই পাইনি।

সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর আদালত সাতটি পর্যবেকক্ষণসহ অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। প্রায় চার বছর ধরে চলা অধিকতর তদন্ত প্রথমে সিআইডি’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি ইসমাইল হোসেন এবং পরবর্তীতে এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী সম্পন্ন করেন। মনিরুজ্জামান ২০১১ সালের ২৬ জুন অস্ত্র আটক ও চোরাচালান সংক্রান্ত দু’টি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন।

অস্ত্র আটক সংক্রান্ত মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে আদালতের চার নম্বর পর্যবেক্ষণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, কোন জলযানের মাধ্যমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদেশ হইতে আনয়ন করা হইয়াছে সেইটির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নাই। এ পর্যবেক্ষণটির বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের চট্টগ্রামের ২৭ জন কর্মকর্তা এবং নৌবাহিনীর ফ্রিগেট বিএনএস-ওসমান এ দায়িত্ব পালনকারী ২১ জন কর্মকর্তা ও নাবিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হইয়াছে। প্রত্যেকের জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। তাহাদের কাহারও নিকট হইতে অস্ত্র পরিবহনকারী মাদার ভ্যাসেল সম্পর্কে কোন তথ্য বা ভেসেলের নাম পাওয়া যায়নাই। কথিত জাহাজটি সেন্টমার্টিন হইতে আরও অনুমান ৩০ নটিক্যাল মাই দূরে গভীর সমুদ্র এলাকায় আসে এবং ট্রলারে অস্ত্র খালাস করিয়া চলিয়া যায়।

এ মামলার অন্যতম আসামী কারাবন্দি হাফিজুর রহমান ২০০৯ সালের ২ মার্চ তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম ওসমান গণি’র আদালতে জবানবন্দি দেন। ওই জবানবন্দিতে হাফিজ জানায়, জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক আজমল হুদা মিঠুর মাধ্যমে একসময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা হাফিজের উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার পরিচয় হয়। ঘনিষ্ঠতার এক পর্যায়ে পরেশ বড়ুয়া তাকে জানায়,  বিদেশ থেকে সমুদ্র ও নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দরের বহি:নোঙ্গরের মাধ্যমে বেশকিছু মেশিনারি পার্টস জাহাজযোগে আসবে। এসব পার্টস খালাসে সহযোগিতার বিপরীতে তাকে ব্যবসায়িক অংশীদার করার কথা বলেন পরেশ বড়ুয়া। রাজিন হন হাফিজ।

২০০৪ সালের ২৩ অথবা ২৪ মার্চ হাফিজ ঢাকার ধানমণ্ডিতে একটি রেস্তোঁরায় পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করেন। কথামত আসিফ নামে এক লোককে হাফিজের সঙ্গে চট্টগ্রামে পাঠান পরেশ বড়ুয়া। মেশিনারি পার্টসগুলো সিইউএফএল জেটিঘাটে নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে হাফিজ ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় আসিফসহ বন্দরের কয়লার ডিপোতে আসেন। সেখান থেকে দু’টি ট্রলার নিয়ে বহি:নোঙ্গর হয়ে রাত ১২টার দিকে গভীর সমুদ্রে রওনা দেন।

২৯ মার্চ রাত আনুমানিক ১০টার দিকে হাফিজ সঙ্গের লোকজনসহ ট্রলার দু’টি নিয়ে সেন্টমার্টিনের ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গভীর সমুদ্র এলাকায় পৌঁছেন এবং কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর নির্দিষ্ট জায়গায় জাহাজের সন্ধান পান। এসময় আসিফ সঙ্গে থাকা কোডওয়ার্ডের মাধ্যমে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন সেটিই মূল জাহাজ। দু’টি ট্রলারে অস্ত্রগুলো জাহাজ থেকে নামিয়ে বোঝাই করতে সময় লাগে প্রায় ১৪ ঘণ্টা। ১ এপ্রিল রাত অনুমান ১০ টা থেকে ১১টার মধ্যে অস্ত্রবোঝাই ট্রলারগুলে‍া সিইউএফএল জেটিঘাটে এসে পৌঁছায়।

সম্পূরক অভিযোগপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম অধিকতর তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের এএসপি ইসমাইল হোসেন তদন্তকালে গোপন সূত্রে তথ্য পান, এমভি বঙ্গবোরাক নামে দেশীয় একটি জাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে তিনটি কনটেইনারে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভর্তি করে চট্টগ্রাম বন্দরে আনার সময় মাঝপথে আসামী হাফিজের তত্তাবধানে খালাস করে। পরে তিনটি খালি কনটেইনার আমদানি দেখিয়ে বঙ্গবোরাক জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।

এএসপি ইসমাইল আগ্রাবাদে এইচআরসি ভবনে গিয়ে জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। খালি কনটেইনার তথ্য জানতে ইণ্টারপোলের সিঙ্গাপুর শাখা এবং চট্টগ্রাম বন্দরেরও শরণাপন্ন হন এএসপি ইসমাইল হোসেন। ২০০৪ সালের ২৪ মার্চ ইণ্টারপোল এক চিঠিতে জানায়, কনটেইনারগুলি খালি অবস্থায় বঙ্গবোরাক জাহাজে ওশান ইণ্টারন্যাশনাল এর প্রতিনিধি বুকিং দিয়েছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষও জানায়, কনটেইনারগুলো খালি অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।

তদন্তে আরও জানা যায়, বঙ্গবোরাক জাহাজটি ২৪০টি কনটেইনার নিয়ে ২০০৪ সালের ২৪ মার্চ সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এর মধ্যে ওশান কনটেইনার লিমিটেডের (ওসিএল) ২৬টি কনটেইনার ছিল যার মধ্যে ২৩টিতে গার্মেণ্টস এক্সেসরিজ এবং তিনটি খালি অবস্থায় এসেছিল।

সম্পূরক অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, অধিকতর তদন্তে ওশান ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের কোন ত্রুটি পাওয়া যায়নি। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে বঙ্গবোরাক জাহাজের জড়িত থাকার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়নি।

তবে হাফিজের জবানবন্দি অনুযায়ী গভীর সমুদ্রে অস্ত্র খালাসকারী জাহাজটির নাম, সেটি দেশি নাকি বিদেশি- এ তথ্যগুলো আর তদন্তে আসেনি। হাফিজুর রহমানও এ বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে।

জাহাজের বিষয়ে তথ্য উদঘাটন করতে না পারলেও অস্ত্রগুলো চীনের তৈরি বলে সম্পূরক অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ আছে, অস্ত্রগুলোতে চীনা মার্কিং আছে। এতে প্রতীয়মান হয়েছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো চীনের তৈরি। কিন্তু সেই দেশ থেকেই অস্ত্রগুলো এসেছে কিনা তার বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ নেই অভিযোগপত্রে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।