ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, সীতাকুণ্ডে এড়ানো যায়নি সহিংসতা

রমেন দাশগুপ্ত ও আবদুল্লাহ আল মামুন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৪
সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, সীতাকুণ্ডে এড়ানো যায়নি সহিংসতা ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ও সীতাকুণ্ড থেকে ফিরে: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের ছদাহা কেফায়েতউল্লাহ কবির আহমেদ উচ্চ বিদ্যালয়। দুপুর ১টার দিকে এ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, তিনজন পুলিশ কনস্টেবল অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের একপাশে।

প্রায় এক’শ গজ দূরে বিচ্ছিন্নভাবে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র তাক করে আছে ভোটকেন্দ্রের দিকে।

ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বরত একজন ওহিদুল ইসলাম নামে একজন এস আই রিভলবার তাক করে ছোটাছুটি করছে পুরো ভোটকেন্দ্রে।
কখনও মহাসড়ক দিয়ে বিজিবি কিংবা সেনাবাহিনীর গাড়ি যেতে দেখলে স্যার, স্যার করে দৌঁড়ে যাচ্ছেন, আবার কখনও সাংবাদিকের গাড়ি দেখলে দৌঁড়ে গিয়ে সহযোগিতা চাচ্ছেন। চরম আতংক নিয়ে এভাবেই ভোটের বাক্স রক্ষা করেছেন ওহিদুল।

শুধু একটি কেন্দ্র নয়, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এবং সীতাকুণ্ড উপজেলার আরও অনেক কেন্দ্রে গিয়েই দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার এরকম অসংখ্য চিত্র চোখে পড়েছে।

জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এবং সীতাকুন্ড অব্যাহত সহিংসতার জন্য চরম স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করেছিল প্রশাসন। কিন্তু ভোটগ্রহণের দিন দু’উপজেলারই  নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারে শিথিল দেখা গেছে। তিন উপজেলার অন্ত:ত ৩৭টি কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

দুর্বল নিরাপত্তার কারণেই নির্বাচনে চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজেলাগুলো অনেকটা নিরুত্তাপ থাকলেও সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বড় ধরনের সহিংসতা এড়াতে পারেনি প্রশাসন। সীতাকুণ্ডেও নাশকতার ঠেকানো যায়নি।

রোববার ভোটগ্রহণ চলাকালে লোহাগাড়ায় নিহত হয়েছেন এক শিবির কর্মী। কয়েকটি কেন্দ্রে সরাসরি হামলা, অগ্নিসংযোগ, ককটেল হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনা হয়েছে। প্রিজাইডিং অফিসারসহ আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সাতকানিয়া-লোহাগাড়াকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। অন্যান্য ভোটকেন্দ্র থেকে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বেশি ছিল। এ কারণে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি।

দুর্বল নিরাপত্তা: সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সাতকানিয়ার প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে দু’জন পুলিশ সদস্য এবং ৭-৮ জন আনসার সদস্য দেয়া হয়েছে। হাতেগোণা কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে পুলিশের সংখ্যা তিনজন কিংবা চারজন করে দেয়া হয়েছে।

সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় মহাসড়কের মূল অংশে সেনাবাহিনীর গাড়ি মাঝে মাঝে টহল দিতে দেখা গেছে। তবে বিজিবি’র গাড়ি তেমন একটা চোখে পড়েনি। আর একেবারে গ্রামাঞ্চলের ভেতরে যেসব কেন্দ্র ছিল তার আশপাশে সেনাবাহিনী কিংবা বিজিবি সদস্যদের টহলও তেমন চোখে পড়েনি।

অব্যাহত ককটেল-সহিংসতা: রোববার ভোটগ্রহণ শুরুর পর সকাল ৯টার দিকে সাতকানিয়ার ঢেমশা আলমগীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ককটেল বিষ্ফোরণ ঘটে। এসময় ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পাশের একটি ভোটকেন্দ্রে কর্তব্যরত দু’জন কনস্টেবল মহিলা আনসার-ভিডিপি সদস্যদের দ্রুত কক্ষে ঢুকে যাবার নির্দেশ দেন।

শনিবার রাতে ঢেমশা আলমগীর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বুথে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব নিয়ে আতংকের কারণে সকাল প্রায় সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কেন্দ্র দু’টির একটিতে কোন ভোটই পড়েনি। আরেকটিতে মাত্র দু’টি ভোট পড়ে।

সাতকানিয়ার চরতি এলাকায় দুরদুরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে ককটেল ও গুলি ছুঁড়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তবে পুলিশ ও বিজিবি ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদের হটিয়ে দেয়। ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয় সকাল সাড়ে ৯টায়।

লোহাগাড়া উপজেলার বড় হাতিয়া ইউনিয়নের ভবানীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে এক শিবির কর্মী নিহত হয়।

নির্বাচন প্রতিহত করার সহিংসতা শুরু হয় শনিবার রাত থেকে। এসময় নয়টি কেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়। এরমধ্যে ছদাহ আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা ও আজিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটি স্থগিত ঘোষণা করেন রিটানিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক মো.আবদুল মান্নান।

ছদাহা আজিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে রাতে মারধর করে পাশের পুকুরে ফেলে দেয় দুবৃত্তরা। কেন্দ্রের দরজা, জানালা, আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ভোটকেন্দ্রে হামলা: সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর ঢেমশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরাসরি ভোটকেন্দ্র আক্রমণ করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এতে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা সাতকানিয়া সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জামাল উদ্দিন এবং দুই সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তা অনিল কান্তি বড়ুয়া ও নাজিমুল ইসলামসহ অন্তত ১০জন আহত হন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হামলার আগে কেন্দ্রটিতে যাওয়ার দুইটি পথে কিছুদূর পর পর অন্তত ১০টি বড় বড় শিরিষ ও মাদার গাছ করাত দিয়ে কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈার করা হয়। গত শনিবার রাত এবং গতকাল রোববার সকালে এসব গাছ কাটা হয়। এর পর হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার খবর পেয়েও গাছের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সেনা ও র‌্যাব পুলিশ যেতে যেতে একঘন্টা লেগে যায়। ততক্ষণে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। নিয়ে যায় কিছু ব্যালট পেপারও।

সীতাকুণ্ডেও একই চিত্র: সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডের মান্দারিটোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর পর একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে বেশকিছু নির্বাচনী সরঞ্জাম পুড়ে যায়। এসময় ওই কেন্দ্রের চারপাশে মুর্হুমুহু ককটেল ও রকেট ফ্লেয়ারের বিস্ফোরণও ঘটে।

ভোটার ছিলনা, জাল ভোট ছিল : সাতকানিয়ার কাঞ্চনা আনোয়ারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১০টার দিকে গিয়ে দেখা যায় ১৫০ ভোট পড়েছে। লাইনে কোনো ভোটার নেই। সাংবাদিকদের দেখে লাইন ধরেছে আওয়ামীলীগ কর্মীরা।

একইভাবে বেলা ১২টায় সাতকানিয়া সরকারি কলেজে গিয়ে দেখা যায় ভোটার নেই। লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যেকের হাতে অমোচনীয় কালি। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি অভিযোগ পেয়েছি। সেটা যাচাই করে দেখছি। ’ ১২টা পর্যন্ত মাত্র ২০০ ভোট পড়ে এই কেন্দ্রে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৪
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।