চট্টগ্রাম: জোয়ারের সঙ্গে সাগরের লোনা জল কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে প্রবেশ করায় পান করার অযোগ্য হয়ে পড়েছে নগরীতে চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা সুপেয় পানি। ফলে নগরবাসীর দুর্ভোগের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট।
অনেককেই খাওয়ার সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দূরান্ত পাড়ি দিতে হচ্ছে, তবে তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে লবণপানির সমস্যা সৃষ্টি হলেও তা সমাধানে বিশেষ কোন অগ্রগতি নেই চট্টগ্রাম ওয়াসার।
তবে এ সমস্যার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ওয়াসা বলছে, সাগরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কারণে এবং উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে লবণাক্ততা বাড়ছে। বারবার জোয়ারের সময় কাপ্তাই হ্রদের পানি ছাড়তে বলা হলেও সে অনুযায়ী কোন কাজ হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণ মিশ্রিত জোয়ারের পানি অনেক দূর পর্যন্ত প্রবেশ করছে। এতে গত কয়েকদিন ধরে ওয়াসার সরবরাহ করা পানি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
এ সংকটের ফলে নগরীর বিভিন্ন এলাকার লোকজন ভিড় জমাচ্ছেন দূর-দূরান্তের বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন টিউবয়েলে। তবে তাও প্রয়োজনের তুলনায় কম।
নগরীর লালখান বাজারের বাসিন্দা মহরুম আলী (৪৫) বাংলানিউজকে বলেন,‘ওয়াসার লাইনের পানিতে লবণ থাকায় বাধ্য হয়ে টাইগারপাস এলাকার একটি টিউবয়েল থেকে পানি আনি। এরজন্য প্রতি কলসে ৪০ টাকা দিতে হয়। ’
অন্যদিকে সামর্থবানরা আবার এ সমস্যা উত্তরণে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সুপেয় পানির জার। এমনই একজন নগরীর কাজির দেউড়ির বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবুল বাশার সোহাগ।
তিনি জানান, বুধবার লবণ মিশ্রিত পানিতে গোসল করে তার পাঁচ বছর বয়েসী ছেলে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বেশি সুপেয় পানি কিনেছেন।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন,‘পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু ওয়াসার পানি খেয়ে মরণের উপক্রম হচ্ছে। গতকাল (বুধবার) গোসল করে আমার ছেলে সারাদিন বমি করেছে। ’
সূত্র জানায়, সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে প্রতিবার এই মৌসুমে লবণাক্ত পানি এলেও গণবিজ্ঞপ্তি ছাড়া বিশেষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি চট্টগ্রাম ওয়াসা। বুধবারও এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী এমএ করিম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন,‘কাপ্তাই পাওয়ার প্লান্টে বাঁধ ও পূর্ণিমার সময় জোয়ারের কর্ণফুলী এবং হালদা নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ফ্লাশিং হয় না। ফলে বিশুদ্ধায়ণ (পিউরিফাইং) করা হলেও পানিতে লবণ থেকে যাচ্ছে। ’
তিনি বলেন,‘এ সমস্যা সমাধানে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ’
ওয়াসা সূত্র জানায়, বর্তমানে ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে নগরীর প্রায় সব এলাকাতেই লবণাক্ততা রয়েছে। তবে মোহরা প্ল্যান্টে সরাসরি উৎপাদিত পানির সঙ্গে ওই এলাকায় স্থাপিত ওয়াসার ছয়টি গভীর নলকূপের পানি মিশিয়ে তা সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াসা। এরপরও লবণাক্ততার পরিমাণ কমানো যাচ্ছে না।
এরমধ্যে নগরীর বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর দুই নম্বর গেইট, জিইসি মোড়, লালখান বাজার, হালিশহর, পতেঙ্গা ও স্টিল মিল এলাকার পানিতে বেশি লবণাক্ততা রয়েছে।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী এমএ করিম চৌধুরী জানান, বিভিন্ন নিরীক্ষায় লবণাক্ততার পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে। এরমধ্যে দেখা গেছে প্রতি লিটার পানিতে সর্বোচ্চ ১০০০ মিলিগ্রাম এবং সর্বনিম্ন ১০০ মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে।
মোহরা প্লান্ট থেকে সরাসরি সরবরাহ করায় নগরীর হালিশহরসহ এর আশপাশের এলাকার পানিতে সর্বোচ্চ লবণ রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
প্রসঙ্গত, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ মিলিগ্রাম লবণ থাকলে তা পান করা যায়।
‘সমন্বয়’ নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে:
এদিকে এই মৌসুমে জোয়ারের সময় কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি ছেড়ে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হলেও তারা সে বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন ওয়াসার কর্মকতারা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফয়জুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন,‘ ‘বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ যদি কাপ্তাই হ্রদ থেকে জোয়ারের সময় পানি ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন তাহলে জোয়ারের পানি হালদা নদীতে প্রবেশ করতো না। এধরনের সমস্যাও হতো না। ’
সূত্রমতে, পরিশোধন করে নগরীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১৯৮৭ সালে হালদা নদীর তীরে মোহরা প্লান্ট স্থাপন করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রথমে লবণপানি প্রবেশ না করলেও ১৯৯৪ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছরই এসমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন নগরীর প্রায় ৫০ লাখ অধিবাসী।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৩
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর।