চট্টগ্রাম: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে ধনাঢ্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে আওয়ামী লীগের নতুন মুখ দিদারুল আলম। স্ত্রীর কাছে দেনায় আছেন সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা আফছারুল আমিন।
চট্টগ্রামে প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের নতুন মুখ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভি’র। দু’জনই আবার শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জমা দেয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ধনাঢ্য প্রার্থী দিদারুল আলম
সীতাকুণ্ডে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দিদারুল আলম হলফনামায় নিজেকে শিল্পপতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৭টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনটির চেয়ারম্যান, কোনটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবার কোনটির পরিচালক বলে তথ্য দিয়েছেন।
এসব প্রতিষ্ঠান হল, মধুমতি ব্যাংক, কুমিরা শিপ ব্রেকার্স লিমিটেড, দিদারুল আলম এণ্ড ব্রাদার্স, আমেনা ফিশিং, এসবি কর্পোরেশন, আলহাজ্ব মোস্তফা হাকিম সিমেণ্ট ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড, গোল্ডেন আয়রণ ওয়াক্স লিমিটেড, ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, তাহের এন্ড কোম্পানি লিমিটেড, মিউচুয়াল জুট স্পিনার্স লিমিটেড, মোস্তফা হাকিম এগ্রিকালচার, গোল্ডেন ব্রিক্স ওয়াক্স লিমিটেড, গোল্ডেন অক্সিজেন, আলহাজ্ব মোস্তফা হাকিম হাউজিং এণ্ড রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, বিডি ফাইনান্স লিমিটেড, মোস্তফা হাকিম ফিলিং স্টেশন এবং মোস্তফা হাকিম ফাউন্ডেশন।
ব্যবসা, পরিচালক সম্মানি, ভোলান্টারি সার্ভিস, শেয়ারসহ বিবিধ খাত থেকে দিদারের বার্ষিক আয় ৮ কোটি, ৮৪ লক্ষ, ৫৮ হাজার ২৩৮ টাকা।
পিএইচডি ডিগ্রিধারী নদভি পেশায় শিক্ষক
আওয়ামী লীগে নতুন মুখ হিসেবে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভি। জামায়াতের ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত নদভি হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে উল্লেখ করেছেন ‘এম এ, পিএইচডি’। পেশার ঘরে লিখেছেন, তিনি চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ এন্ড ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
পেশায় অধ্যাপক নদভি’র আল ইত্তেহাদ প্রপার্টিজ লিমিটেড নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে ৪৭ হাজার টাকা মূল্যের ৪৭০ টি শেয়ার আছে। ইসলামী ব্যাংকে জমা আছে তিন লক্ষ ১২ হাজার ৮৩৯ টাকা ৭০ পয়সা। বিয়ের সময় তিনি ৫০ তোলা স্বর্ণালংকার উপহার হিসেবে পেয়েছেন। স্ত্রী’র কাছে দশ ভরি স্বর্ণালংকার।
হাছান মাহমুদের ‘পেশা’ মন্ত্রিত্ব
বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন পিএইচডি। পেশার ঘরে উল্লেখ করেছেন, শিক্ষকতা ও ব্যবসা। একই ঘরে বর্তমান পেশা উল্লেখ করেছেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী’।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া-বোয়ালখালী) আসনে গত দু’নির্বাচনে হাছান মাহমুদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হাছান মাহমুদের ব্যাংক জমা বেড়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। এবার ব্যাংক জমা দেখানো হয় ৮ লাখ টাকা। হাতে নগদ চার লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ টাকায়। স্থাবর সম্পদে ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকার একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, খুলশীতে ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার একটি জায়গা এবং খুলশী মৌজায় ১৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যের ছয় কাঠা জমি দেখানো হয়। এছাড়া পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাকলিয়ায় ১২ কাঠা, দানপত্র সূত্রে পাওয়া ৫ কাঠা জমিও দেখানো হয়েছে।
২০০৮ সালের হলফনামায় ঢাকার পূর্বাচলে চার কাঠা জমি দেখানো হয়, যার মূল্য ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া তখন দুইটি প্লটের অগ্রিম বাবদ ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেখানো হয়। ২০০৮ সালে স্ত্রীর নামে কোনো স্থাবর সম্পদ না থাকলেও এবার স্ত্রীর নামে গাজীপুরে ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার ৩ কাঠা, রাঙ্গুনিয়ায় এক কোটি ৭৮ লাখ টাকার তিন একর জমি দেখানো হয়। রাঙ্গুনিয়ার জমিতে এতিমখানা ও কারিগরি বিদ্যালয় করার জন্য কেনা বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সিরাজউদ্দৌলা সড়কে এক গন্ডা এবং ঢাকার সোনারগাঁওয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার দুইটি অফিস স্পেস আছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যারিস্টারের পেশা রপ্তানি
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ‘ব্যারিস্টার আনিস’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে ‘বার এট ল’ উল্লেখ থাকলেও হলফনামার তথ্যে দেখা গেছে, তিনি আইন পেশার সঙ্গে জড়িত নন।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পেশা হিসেবে লিখেছেন, টেক্সটাইল ও গার্মেণ্টস প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারক। পরিচালক হিসেবে বছরে ৩০ লক্ষ টাকা তিনি সম্মানি ভাতা পান।
আফছারুলের কাছে টাকা পান স্ত্রী
চট্টগ্রাম-১১ (ডবলমুরিং, খুলশী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী আফছারুল আমিনের ঋণ আছে ৮৫ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে স্ত্রী পান ১০ লক্ষ টাকা। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দু’দফায় ৫০ লক্ষ ও ১০ লক্ষ টাকা করে মোট ৬০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্রিম হিসেবে গ্রহণ করেছেন ১৫ লক্ষ ৮ হাজার টাকা।
ডা. আফছারুল আমীনের স্ত্রীর ব্যাংক ও নগদ জমা গত পাঁচ বছরে বেড়েছে। এবার তার মোট ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৫১৪ টাকা নগদ ও ব্যাংকে রয়েছে বলে। গতবার তা ছিল সাত লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ টাকা। তবে তার স্থাবর সম্পদ বাড়েনি। মন্ত্রীর স্থাবর সম্পদও আগের মতো আছে। তবে তার ব্যাংক ও হাতে নগদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। আগে তা ছিল ৩৬ হাজার দুই টাকা।
স্থাবরে ধনী মোশাররফ, অস্থাবরে স্ত্রী
মোশারফের স্ত্রীর নামে ২০০৮ সালে ব্যাংক ও হাতে নগদ ছিল মোট চার লাখ ৪৮ হাজার ৩৫ টাকা। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ২৩ লাখ ৮২ হাজার ৯৪৫ টাকা। তার মধ্যে হাতে নগদ ছয় কোটি টাকা। তবে স্ত্রীর স্থাবর সম্পদ গত পাঁচ বছরে কমেছে। এবার তাঁর স্থাবর সম্পদ দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে ছিল ৯৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা সমপরিমানের।
তবে মোশরাফ হোসেনের নিজের স্থাবর সম্পদ গত পাঁচ বছরে বেড়েছে। এবার এক কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ দেখানো হয়। পাঁচ বছর আগে এটি ছিল ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। গতবার এই সাংসদের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে হাতে নগদ ও ব্যাংক জমা দেখানো হয়েছিল ৫০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এবার তা কমে হয়েছে ৩৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
পরামর্শ দিয়েই আয় ভান্ডারির
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করছেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি। হলফনামায় তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লিখেছেন ‘এইচএসসি’। আর পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কনসালট্যান্সি।
আর এ খাত থেকেই তিনি বছরে আয় দেখিয়েছেন ৭ লক্ষ ২৬ হাজার ৫৫৩ টাকা। ভান্ডারির স্ত্রী’র আয় দু’লক্ষ ৮২ হাজার ৪২০ টাকা, প্রথম ছেলে ২ লক্ষ ৫৫ হাজার ৭১২ টাকা ও দ্বিতীয় ছেলের আয় দেখানো হয়েছে ২ লক্ষ ৫৩ হাজার ২৫১ টাকা।
ভান্ডারি ও তার স্ত্রী উভয়ই স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক থেকে হোম লোন নিয়েছেন ১৪ লক্ষ ৬ হাজার ৬১৮ টাকা করে ২৮ লক্ষ ১৩ হাজার ২৩৬ টাকা।
আয়ের খাত বেড়েছে বাদলের
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ) আসনে ১৪ দলের প্রার্থী ও জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সভাপতি সাংসদ মঈনউদ্দিন খান বাদলের গত পাঁচ বছরে তিনটি নতুন আয়ের খাত সৃষ্টি হয়েছে।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দাখিল করা হলফনামায় শুধুমাত্র কৃষিখাত থেকে তার বার্ষিক আয় উল্লেখ করা হয়েছিল ২ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। তার নির্ভরশীলদের কোন আয়ের কথাই উল্লেখ ছিলনা এ হলফনামায়।
এবারের হলফনামায় বাদলের কৃষিখাতের আয় কমে হয়েছে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। তবে নতুন দু’টি খাত ব্যবসা থেকে তিনি ১ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা ও ব্যাংক সুদ থেকে ১৮ হাজার ২১২ টাকা বার্ষিক আয় উল্লেখ করেছেন। আর তিনটি খাতে তার নির্ভরশীলদের আয় দেখানো হয়েছে যথাক্রমে কৃষিখাতে ৫০ হাজার টাকা, ব্যবসা খাতে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৯৯৬ টাকা এবং ব্যাংকের সুদ বাবদ ৫৯ হাজার ২৬৪ টাকা।
এছাড়া সংসদ সদস্য হিসেবে গত পাঁচ বছরে তিনি বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকা করে পারিতোষিক পেয়েছেন।
তবে বাদলের স্থাবর সম্পদ বাড়েনি। সাতে তিন কানি (স্থানীয় হিসেবে) জমি, ১০২ কানি পাহাড় এবং তিনটি পৈতৃক পুকুরই এখনও আছে তাদের পারিবারিক সম্পদ হিসেবে।
আর ২০০৮ সালের হলফনামায় বাদল একক অথবা যৌথভাবে ১৭ লক্ষ টাকা ঋণের কথা উল্লেখ করলেও গত পাঁচ বছরে তা শোধ করেছেন। এবারের হলফনামায় তিনি কোন ঋণের কথা উল্লেখ করেননি।
বাংলাদেশ সময়: ২১১১ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯,২০১৩
সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর।