ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

করোনার টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যুক্ত হয়েছে নতুন উপসর্গ

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৮ ঘণ্টা, মে ৩, ২০২৪
করোনার টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যুক্ত হয়েছে নতুন উপসর্গ ...

চট্টগ্রাম: করোনা সংক্রমণের ফলে গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জন্ম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে-চিকিৎসকের এমন সতর্কবাণীতে টিকা নিয়েছিলেন নগরের পাথরঘাটার বাসিন্দা ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী। দুই ডোজ নেওয়া শেষে বুস্টার ডোজও নিয়েছিলেন।

সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তার শরীরে দেখা দেয় অ্যালার্জি। সেই থেকে নানান ওষুধ খেয়েও কমেনি সমস্যা।

ষাটোর্ধ্ব শিক্ষক সামিউল হাসান স্নায়বিক সমস্যায় ভুগছেন। তাঁর এ ধারণা হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর থেকে। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, তিনবেলা খেতে হয় ৮-১০টা ওষুধ।

২০২০ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ২৫ মে একজনের মৃত্যু হয়। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৪৫ জন। মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৩৭১ জনের। এদের মধ্যে ৭৩৮ জন চট্টগ্রাম মহানগরের এবং ৬৩৩ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় করোনার টিকাদান কর্মসূচি। চট্টগ্রামে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়। সংখ্যার হিসাবে যা ৪০ লাখের কাছাকাছি। এ ছাড়া দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ, যা প্রায় ৩১ শতাংশ। তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের পাশাপাশি হার্ড ইমিউনিটি আনতে নিবন্ধন ছাড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে টিকার চতুর্থ ডোজ দেওয়া শুরু হয়। তবে এতে তেমন সাড়া মিলেনি। ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে ৫-১১ বছর বয়সী শিশুদের করোনা টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। লক্ষ্যমাত্রা ছিল মোট ৪ লাখ শিশু।  

করোনাকালে ফাইজার ও বায়োএনটেকের তৈরি টিকা, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা, সিনোফার্ম, মডার্না, সিনোভ্যাক, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকাও দেওয়া হয় গ্রহীতাদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ৭৪ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ৫৫ শতাংশ টিকাগ্রহীতা বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি। ৫৮ শতাংশ বলেছেন, প্রথম ডোজ নেওয়ার পর টিকা নেওয়ার স্থানে ব্যথা হয়েছিল, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর এই হার ছিল ৪৯ শতাংশ। প্রথম ডোজ নেওয়ার পর জ্বর হয়েছিল ৩৩ শতাংশের, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর সেই হার কমে দাঁড়ায় ২১ শতাংশে। প্রথম ডোজ নেওয়ার পর মাথাব্যথা হয় ২১ শতাংশের এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পর তা কমে ৮ শতাংশ হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথমদিকে সাত লাখ ৪৮ হাজার ৭৪৯ জন টিকা গ্রহীতার মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে ১৬৬ জনের।

সম্প্রতি টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা স্বীকার করেছে ওষুধ নির্মাতা কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের তৈরি এই টিকার কারণে বিরল থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম (টিটিএস) হতে পারে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে প্রদাহ এবং ফুলে যাওয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শনাক্ত হয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ টিকা নেওয়ার পর হালকা গা ব্যথা, লালচে হয়ে যাওয়া, চুলকানি, টিকা দেওয়ার স্থান ফুলে যাওয়া, সেখানে ক্ষত হওয়া, অসুস্থ ও ক্লান্ত বোধ করা, জ্বর, মাথাব্যথা, বমিভাব, ফ্লুর উপসর্গ- ইত্যাদি দেখা দিতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে।

গ্লোবাল ভ্যাকসিন ডেটা নেটওয়ার্কের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণায় অন্যান্য টিকার তুলনায় ফাইজারের টিকায় এলার্জিক প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি মাত্রায় দেখা গেছে। ফাইজার-মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রভাবে মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড ও রক্তে জটিলতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ে।  

গবেষকরা বলেছেন, ফাইজার বায়োএনটেক কিংবা মডার্না টিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ নেওয়াদের একাংশ ইতিমধ্যে মায়োকার্ডিটি নামে হৃদপিণ্ডের সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই সমস্যায় আক্রান্তরা হার্টের মাংসপেশির সার্বক্ষণিক প্রদাহে ভোগেন। আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৃতীয় ডোজ যারা দিয়েছেন, তাদের একাংশ আক্রান্ত হয়েছেন পেরিকার্ডিটিতে। এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে হৃদপিণ্ডের কার্ডিয়াক মাংসপেশিতে প্রদাহ হয়। ফাইজার ও মডার্নার দ্বিতীয় ডোজ মায়োকার্ডিটির ঝুঁকি ২ দশমিক ৯ গুণ এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৃতীয় ডোজ পেরিকার্ডিটির ঝুঁকি ৬ দশমিক ৯ গুণ বৃদ্ধি করে।  

এছাড়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার-মডার্নার ডোজে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া, গুলেন বারি সিনড্রোম এবং মায়েলিটিসের মতো শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে ২ দশমিক ৫ গুণ। গুলেন বারি সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীরা স্নায়বিক সমস্যায় ভোগেন আর মায়েলিটিসে আক্রান্তরা ভোগেন মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের প্রদাহে।

করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিরোধে গাইডলাইন করে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সেখানে টিকা নেওয়ার পর শরীরে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ২৮ মে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ১০ দিন পর সুস্থ হলেও পাঁচদিনের মাথায় মারা যান ডা. এ এ গোলাম মর্তুজা হারুন। তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ে। একই জটিলতায় মারা যান ডা. ফরিদুল আলম। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এরকম অনেক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, যারা মানসিক সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, দুর্বলতা, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে করোনার পরবর্তী সমস্যা নিয়ে হাজির হন অনেকে।

করোনাযোদ্ধা ডা. আবদুর রব মাসুমের মতে, কোভিড পরবর্তী সমস্যা স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। যাদের হাসপাতালে ভর্তি বা অক্সিজেন নেওয়ার ইতিহাস আছে, তাদের অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে। মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। ১০ লাখে এক-দুইজনের মধ্যে অ্যালার্জির রিঅ্যাকশন হতে পারে।  

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। এছাড়া যারা আগে থেকেই হাইপারটেনশন, হার্টের জটিলতা, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও কিডনি জটিলতায় ভুগছেন, তাদেরকে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০২৪ 
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।