ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ক্রিকেট

মেয়েটি থাই ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২২
মেয়েটি থাই ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা নাত্তায়া বুচাথাম/ছবি: শোয়েব মিথুন

সিলেট থেকে: ইন্টারনেট ঘেটে তার গল্পের কিছুটা জানা গিয়েছিল আগেই। কৌতূহলী মনে এরপর প্রশ্ন জমা হয়েছে অনেক।

এসবের উত্তর জানতে নাত্তায়া বুচাথামের সঙ্গে কথা বলার বিকল্প নেই। এখানেই অবশ্য বিপত্তি। একই সঙ্গে ক্রিকেটার, কোচ, স্কুল শিক্ষক; অনেক কিছুতে পারদর্শী হলেও ইংরেজি তিনি পারেন না।  

থাই ম্যানেজার খুররাম গিলানির সঙ্গে চলতে-ফিরতে যতবার দেখা, ততবারই বুচাথাম প্রসঙ্গ চলে আসতো অবধারিতভাবে। ভদ্রলোক হাসি দিয়ে বলতেন, ‘তোমার ফনকে (ডাকনাম) নিয়ে এত আগ্রহ, কিন্তু সে তো ইংরেজি বলতে পারে না! কীভাবে কথা বলবে?’ বহুবার আলাপে একটু আবদারের সুরেই তার কাছে জবাব যেতো, ‘তুমি আছো কী করতে!’ 

ম্যানেজার আবার হাসতেন। কবে কথা বলিয়ে দেবেন জানতে চাইলে আজ-কাল করতেন। অবশেষে তার সেই সময় হলো যখন থাইল্যান্ডের মেয়েরা লিগ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচটা খেলে ফেলল। চওড়া হাসি দিয়ে খুররাম বললেন, ‘ফাইনালি...’ এরপর নিজে হলেন অনুবাদকও।

এমনিতে ভারতে কোচ হার্শাল পাঠকের অধীনে ক্যাম্প টুকটাক ইংরেজি শিখেছেন। ওই আশা থেকেই চেষ্টা চললো সরাসরি যদি কথা বলা যায়- গেল না! থাই টিম বাসের সামনে দাঁড়িয়ে ফনের কাছে তাই প্রথম প্রশ্ন, ‘কোনটা কঠিন- ক্রিকেট নাকি ইংরেজি?’

ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিতে হলো ছোট্ট কথাটিও। এরপরই হাসতে শুরু করলেন বুচাথাম, ‘অবশ্যই ইংরেজি... ক্রিকেট অনেক সহজ। ’

থাইল্যান্ডের হয়ে  ৫৬ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে অব্য এক রেকর্ডও আছে তার। নারীদের টি-টোয়েন্টিতে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি ৪০ উইকেট বুচাথামের। এবার থাইল্যান্ডের যে দলটা এশিয়া কাপের সেমিফাইনাল খেলছে, তাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার।

বুচাথাম একই সঙ্গে থাইল্যান্ডে ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। নিজের ক্রিকেট খেলার ব্যস্ততা যখন থাকে না- তখন স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়ান, ক্রিকেট শেখান। ক্রিকেট তার জীবনের সবকিছু। আক্ষরিক অর্থেই তাই।

কীভাবে ক্রিকেটের প্রেমে পড়লেন? বুচাথাম থাই ভাষায় বলতে শুরু করলেন, ‘শুরুর দিকে আমি সফট বল খেলতাম। এরপর সফট বলের কোচ একদিন আমাকে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওখান থেকেই শুরু। এরপর উপভোগও করতে শুরু করলাম। কারণ ক্রিকেটে এমন অনেক কিছু আছে যেটা সফট বলে নেই। এখানে সবসময় আপনার মনোযোগ ধরে রাখতে হবে। ’

ক্রিকেটে মনোযোগ দেওয়া শুরুর পর আর কখনোই সরিয়ে নেননি বুচাথাম। ক্রিকেট ‘অবসেশনে’ ভুগেছেন। তার বাড়িতে কীভাবে ক্যাবল কানেকশন বসলো, ওই গল্পটা জানলেই বুঝতে পারার কথা। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ১৭৬ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলেছিলেন ভারতের বর্তমান অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌর।

ম্যাচটা দেখতে পারেননি বুচাথাম। ওই আফসোসে এখনও পোড়েন। পরদিনই ডিশ লাইন নিয়ে এসেছিলেন বাসায়। বুচাথাম পুরোনো ঘটনা স্মরণ করে বলছিলেন, ‘তখন সবকিছু কঠিন ছিল। থাইল্যান্ডের কোনো চ্যানেল ক্রিকেট দেখাতো না। এখন অবশ্য ইন্টারনেট আছে, চাইলে পরে খেলা দেখে নেওয়া যায়। ’

২০১৯ সালে পুনেতে ক্যাম্প করছিলেন বুচাথাম। সেখানেই বিরাট কোহলির ২৫৪ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসের সাক্ষী হয়েছিলেন। দেখার চেয়ে বেশি করেছেন অবশ্য প্রশ্ন। এতটাই যে কোচ হার্শাল পাঠক বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ‘আমি যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করি, এরপর খুব ভালোভাবে জড়িয়ে পড়ি। তারপর আবার ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হই। প্রতিটা দিন ও রাত কাটে ক্রিকেটের কথা ভেবে। ’

থাইল্যান্ডে ক্রিকেট আদতে কেমন? এ নিয়ে প্রশ্ন গিয়েছিল হেড কোচ হার্শাল পাঠকের কাছে। তিনিই বোধ হয় সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করেছেন পরিস্থিতির, ‘আপনি-আমি যেমন জন্মের পর থেকে ক্রিকেট দেখি। রাস্তায় ব্যাট হাতে নেমে পড়ি। এরা তেমন না। ’

‘ওদের আসলে প্রথমে খেলাটা বোঝাতে হয়, কীভাবে ব্যাট ধরতে হয়, বল করতে হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা তৃণমূলে গিয়ে ক্রিকেট শেখায়। বিশ্বাস করুন এটা সহজ না। প্রথমে খেলার নিয়ম শিখিয়ে পরে তাদের খেলতে নামানো সহজ কাজ না। ’

এই কঠিন কাজের শুভেচ্ছা দূত বুচাথাম। তিনি স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়ান। ক্রিকেট শেখান অথবা ফেরি করে বেড়ান। তাতে যে তিনি বা তারা সফল হচ্ছেন, এর প্রমাণ এবারের নারী এশিয়া কাপ। বাংলাদেশকে টপকে সেমিফাইনালে উঠে গেছে তারা, হারিয়েছে পাকিস্তানকে।

কীভাবে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ছে ওই গল্প শোনাচ্ছিলেন ‘ফন’, ‘ক্রিকেট আমাদের ওখানে এখনও তেমন জনপ্রিয় না। কিন্তু দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। শুরুর দিকে আমরা হয়তো ৮-১০টা রাজ্যে ছিল, এখন ক্রিকেট ২৬টা রাজ্যে হয়। মানুষ দিন দিন ক্রিকেট নিয়ে আরও বেশি জানছে। মেয়েদের জেতা খেলাটাকে আরও ছড়িয়ে দিচ্ছে। ’

ডেভিড ওয়ার্নার তার প্রিয় ক্রিকেটার। বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন। কিন্তু থাইল্যান্ডের প্রান্তিক কারো কাছে হয়তো ক্রিকেট মানে কেবল ফন। খেলাটার সত্যিকারের ফেরিওয়ালা অথবা ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসডর’। পরের শব্দ দুটি জুড়লে নাম, যশ, খ্যাতি মেলে; ফনদের কিছুই থাকে না হয়তো। তবে তাদের ‘প্রতি দিন-রাত কাটে ক্রিকেটের কথা ভেবে। ’ এই কাজ কতটুকু জরুরি, একদিন নিশ্চয়ই সেটাও সবখানে ছড়িয়ে পড়বে!

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২২
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।