ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জীবন-জীবিকা

মরলে মোগো মাডি দেবে খাস পুহুরের পাড়ে

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৪ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২০
মরলে মোগো মাডি দেবে খাস পুহুরের পাড়ে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া উপকূলবোসী। ছবি: বাংলানিউজ

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় বাসিন্দাদের জীবন চলে অতি কষ্টে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগের সঙ্গে তাদের বসবাস। প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই বেঁচে থাকে উপকূলবাসী। আবার অনেকের ভিটেমাটি না থাকায় সরকারি জমিতে থাকেন। নিজ দেশে পারবাসী হয়ে থাকছেন তারা। মারা গেলে দাফন করার মতো এক টুকরো জমি নেই অনেকের। উপকূলবাসীর অন্তহীন দুর্দশা এবং জীবন-জীবিকার চিত্র নিয়ে পাথরঘাটা উপজেলা করেসপন্ডেন্ট শফিকুল ইসলাম খোকনের প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব।

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: দীর্ঘ ২৩ বছর আগে একমাত্র সন্তানসহ খাদিজা বেগমকে রেখে মারা যান তার স্বামী। সেই থেকেই সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন যাপন করছেন তিনি।

নদীর পাড়ে ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরছেন, আবার সেগুলো বাছাই ও শুঁটকির কাজও করছেন নিজেই। এতো কষ্টের পরেও তাদের মাথা গোঁজার মতো ঠাই নেই। এক টুকরো নিজস্ব জমিও নেই তার। সরকারি জমিতে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটিতেই থাকছেন খাদিজা।

বিশ্বঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ঘেঁষা পশ্চিমে বলেশ্বর, পুর্বে বিষখালী নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর মাঝখানেই পাথরঘাটা উপজেলা। এখানের অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর এবং মৎস্য পেশার উপর নির্ভরশীল। উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার মানুষ সব সময়ই দুর্যোগের সঙ্গে এক রকমের আলিঙ্গন করেই বসবাস করে। সিডর, আইল, মহাসেন,কোমেন, রোয়ানু, ফণি, বুলবুল, আম্পান। এসব কিছুই যেন এখানকার বাসিন্দাদের  জীবনসঙ্গী।

খাদিজা বেগম।  ছবি: বাংলানিউজএ অঞ্চলের মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করে কিন্তু রাতে ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমনোর মতো জায়গাটুকু নেই। অনেক আগেই পূর্ব পুরুষের জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সেই থেকে খাস জমি বা অন্যের জমিতে বসবাস তাদের। আর যাদের জমি আছে তাদের অধিকাংশেরই নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। বাড়িঘর নদীতে বিলীন হওয়ায় বেড়িবাঁধের উপর বসবাস করে আসছিলেন। সম্প্রতি সেখান থেকেও নেমে যেতে হয়েছে বেড়িবাঁধ মেরামত করা হচ্ছে বলে। খাদিজা, লাইলী, হাসান ও লতিফের মতো অসংখ্য বাসিন্দাই ভূমিহীনদের তালিকায়।

উপকূলবর্তী বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর পাড় ঘুরে দেখা যায় এসব অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা। চোখে না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। এখানে অধিকাংশ মানুষের শরীরের চামড়া লবণ পানির ছোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। রোদে পুড়ে মাছ শিকার করে লবণ পানির কারণে তাদের শরীর টেকসই হয়ে গেছে। জেলেদের ভাষায় করোনাও তাদের কাছে কিছু নয়।

সরেজমিন জিনতলা গ্রামে গিয়ে কথা হয় বাঁধবাসী ৩০ বছরের হাসান খলিফার সঙ্গে।

তিনি বলেন, সারাদিন নদীতে মাছ ধরি। যা পাই তা বিক্রি করে সংসার চালাই। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বহু বছর আগে। খাস জমিতেই থাকি।

কথা হয় আরেক বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী আব্দুল লতিফ মুন্সির সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার জমি যা ছিল তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বহু বছর ধরে খাস জমিতে থাকছি। এখন বেড়িবাঁধের মধ্যে অন্যের জমিতে থাকি।

কথা হয় বাঁধ সংলগ্ন বসবাসকারী ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, জন্মের থেইকা বাপ-দাদার জমি দেহি নাই, আবার স্বামীর বাড়ি আইয়াও শ্বশুরের জমি পাই নাই। সরকারি জমিতে ঘর উডাইয়া থাহি, মোরা মরলে লাশটা কবর দেবে পুহুরের পাড়ে! মইরাও মেগো জাগা (জমি) অইবেনা।

স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সংকল্প ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বাংলানিউজকে বলেন, পাথরঘাটা উপজেলা উপকূলবর্তী হওয়াতে দিনে দিনে নদীর গর্ভে বিলীন হচ্ছে এ অঞ্চলের ভিটেমাটি। যুগযুগ ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। সত্যিকার অর্থে সরকারেরও কিছুই করার নেই এ ক্ষেত্রে। তারপরেও সরকার থেকে ভূমিহীনদের আবাসনের ব্যবস্থাও রয়েছে। যদিও আমাদের এ অঞ্চলের যেসব আশ্রয়ন প্রকল্প রয়েছে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চলমান আবাসনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহারের উপযোগী করার ক্ষেত্রে আরও কঠোর নজরদারি থাকা দরকার।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।