ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

‘জল’ কর্তন, তবুও বৈষম্যে ‘জলদাস’

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৪
‘জল’ কর্তন, তবুও বৈষম্যে ‘জলদাস’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাবাজার, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম থেকে : আদি পেশা জলদাস সম্প্রদায়ের বংশ-পরিচয় বদলে যাচ্ছে। ‘জল’ কর্তন করে তারা এখন শুধুমাত্র ‘দাস’ পরিচয়ে অভ্যস্ত।

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যেন জলদাস পরিচয় দেওয়াটা এই সমাজে মারাত্মক অপরাধের। পরিচয় দিতে গিয়ে বাপ-দাদার আদিবৃত্তি ‘জলদাস’ পরিচয় দিতে তারা এখন আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি পেতেই নিজেদের আড়াল করার এই চেষ্টা- জানালেন এ সম্প্রদায়ের অনেকেই।

সন্দ্বীপের সর্বদক্ষিণে সমুদ্র মোহনায় আদি পেশা জলদাস পাড়ায় আলাপকালে অনেকেই জানালেন এ সমাজের নানা ক্ষেত্রে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কথা। অন্য সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাতে তাদের আর কোনো সমস্যা নেই বটে, কিন্তু এখনও গ্রাম্য দোকানপাটে জলদাস সম্প্রদায়ের লোকজনের আড্ডায় অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আছে এমন নানা দৃষ্টান্ত।

সূত্র বলছে, কালের বিবর্তনে এ সম্প্রদায়ের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। পিছিয়ে থাকা এ সম্প্রদায়ের লোকজনও নানা চেষ্টা করছেন। তাদের নেওয়া নানা পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে বংশ-পরিচয় সংশোধন। কিন্তু এটা যে নিজেদের কাছে অসম্মানের, তা অনেকেই বোঝেন। তারপরও কিছুই করার নেই তাদের। আবার বংশ পরিচয়ে ‘জলদাস’-এর বদলে ‘দাস’ বললে অনেকে জিজ্ঞেস করেন ‘স’ নাকি ‘শ’। বংশ-পরিচয় আড়াল করে সমাজে টিকে থাকার এ এক অন্যরকম লড়াই।

সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজারের গুণধর জলদাসের কলেজ পড়ুয়া ছেলে কমল চন্দ্র জলদাস বাংলানিউজকে জানালেন, স্কুলে রেজিস্ট্রেশনের সময় তার নামের সঙ্গে জলদাসের বদলে দাস লিখে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। জলদাসের স্থলে দাস লেখা প্রসঙ্গে ওই স্যারকে প্রশ্ন করেছিল কমল। তখন শিক্ষক জানিয়েছেন, চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্যা হবে বলে তার নামের সঙ্গে জলদাস না লিখে শুধু দাস লেখা হয়েছে।

বংশ-পরিচয় বদলে বৈষম্য রোধ হয়নি উল্লেখ করে কমল চন্দ্র জানালেন, ‘দাস’ পরিচয় এখন সবাই প্রশ্ন করে ‘স’ নাকি ‘শ’। তাহলে আমরা কী পদবি বদল করেও বৈষম্য রোধ করতে পারছি, প্রশ্ন জলদাস সম্প্রদায়ের এই তরুণের।

প্রসিদ্ধ মাছের ঘাট হিসাবে পরিচিত বাংলাবাজারের ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের ঢালে মো. জামসেদের ছোট্ট চায়ের দোকান। শুধু চায়ের দোকান বললে ভুল হবে, এখানে কলা, রুটি, বিস্কিট, কোমল পানীয়, বিড়ি-সিগারেট সবই পাওয়া যায়।

অলস ভর দুপুরে এ দোকানে আড্ডায় বসেছিলেন বেশ কয়েকজন জলদাস সম্প্রদায়ের লোক। কেউ কেবলমাত্র নদী থেকে জাল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন, কেউবা বাজারের দোকানে কিছু সদাই-পাতি নিতে এসেছেন। এরই ফাঁকে দোকানে খানিকক্ষণ বসে সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় সময় পার করছেন তারা।

এ দোকানে জলদাস সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে আলাপে সমাজের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রসঙ্গ ওঠে। নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরার সময় জেলেপাড়ার বয়সী জলদাস নাগরিকদের কণ্ঠ ভারি হয়ে ওঠে। তারা পদে পদে বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন। সালিশ-বিচারে জলদাস সম্প্রদায়ের লোকেরা পান না ন্যায়বিচার। প্রথাগত এ সমাজের ‘নিচুস্তরের নাগরিক’ বলে জোরালো কণ্ঠে কথা বলার অধিকার হারিয়ে ফেলেন তারা।

একজন বলছিলেন, এ সম্প্রদায়ের লোকজন নির্বাচনে ভোট দেন। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নির্বাচনের আগে তাদের ভোট নিতে তৎপরতা দেখা যায় প্রার্থীদের। কিন্তু নির্বাচনের পরে আর কারও নজর থাকে না এ সম্প্রদায়ের লোকজনের প্রতি। জলদাসরা বাঁচলেন, নাকি মরলেন কেউ খোঁজ নেন না- আক্ষেপের সঙ্গে বললেন গুণধর জলদাস।

সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযোগ করেন, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ মানেই এ সম্প্রদায়ের লোকজনের মাঝে আতঙ্ক। নির্বাচন এলে ভয়ভীতি বাড়ে। নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতনের ঘটনা এখানে বহুবার ঘটেছে। অনগ্রসর এ সম্প্রদায়ের ওপরই যেন সব দায়। তাদেরকে নির্যাতন সয়ে সয়ে দিন পার করতে হয়। তারপরও সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার।

আলাপে জানা গেলো, গোটা সন্দ্বীপে জলদাস সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ৪-৫ জন মেয়ে মাধ্যমিক অতিক্রম করে কলেজ পর্যায়ে যাওয়ার ‘সুযোগ’ পেয়েছে। সুযোগের বিষয়টি এখানে অত্যন্ত মুখ্য। কারণ, সুযোগের অভাবেই এ সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনায় পিছিয়ে। মেয়েদের লেখাপড়া এখনও অনেকে কল্পনাই করতে পারেন না। সমাজের অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল জনগোষ্ঠী’ বলে জলদাস ঘরের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে। কারণ ১৪-১৫ বছরের মেয়েদের ঘরে রেখে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার সামর্থ্য এ সম্প্রদায়ের নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, সন্দ্বীপে বসবাসকারী সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ জলদাস। আর বাংলাবাজারে রয়েছেন তিন শতাধিক পরিবারের প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক। এ সম্প্রদায়ের লোকেরা বংশপরম্পরায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এক সময় নদী থেকে মাছ ধরে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করতেন।

জলদাস সম্প্রদায়ের একজন বয়সী ব্যক্তি বলছিলেন, বাড়ি বাড়ি মাছ ফেরি করার সময় কোনো বাড়ি থেকে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা এক গ্লাস পানি পান করার সুযোগ পেতেন না। সমুদ্র থেকে তাদের ধরে আনা মাছ খাওয়া যাবে; কিন্তু স্পর্শ করাতেও যেন ছিল পাপ। আশাপাশের মুসলমান সম্প্রদায় তো দূরের কথা, অন্য পদবিধারী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। পাশ্ববর্তী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এরা এখনও অবজ্ঞার পাত্র হয়েই আছে।

সময়ের বিবর্তনে সমাজ এগিয়েছে অনেক দূর। জলদাস সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় কী এখনও আসেনি?- এ প্রশ্ন নিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন জলদাস সম্প্রদায়ের বৈষম্যের শিকার হাজারো মানুষ।    

বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।