ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জলদাস, দাদনের বৃত্তে বন্দী জীবন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
জলদাস, দাদনের বৃত্তে বন্দী জীবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুমিরা, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম থেকে: ছোট হয়ে এসেছে মাছের ঝুঁড়ি। ভারী মাছের বোঝা নিয়ে এখন আর হাঁপাতে হাঁপাতে বাজারের দিকে ছোটে না কেউ।

নিস্প্রাণ মাছের বাজার। কোলাহল নেই জেলে পাড়ায়। ব্যস্ত হয়ে সমুদ্রের মাছ পরিবহনে ঘাটের দিকে ছোটে না ট্রাকের দল। কুমিরা বাজারের এক সময়ের ব্যস্ত পুবের আকাশ লাল করা ভোরটাও তাই জনশূন্য পড়ে রইলো।

গল্পটা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা মাছঘাটের। এখানকার সমুদ্র কিনারে অলস পড়ে থাকা অসংখ্য মাছধরার নৌকা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এখানকার জেলে সম্প্রদায়ের কথা। সরেজমিনে গিয়ে শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোরে কুমিরায় এই দৃশ্য চোখে পড়ে বাংলানিউজের। ঝিমিয়ে থাকা জেলেপাড়ার চিত্র দেখতে দেখতেই কয়েকজন জলদাসের সঙ্গে আলাপ। মাছ না থাকার এই সময়টাতে যেন মলিন মুখেই চায়ের দোকানে আড্ডা তাদের।     

সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরা আর ছোট কুমিরায় প্রায় দশ হাজার জলদাসের বসবাস। বাপদাদার ভিটেয় আছেন এদের অনেকেই। কেউ আবার সমুদ্রের ভাঙনে সব হারিয়ে কোনোমতে ভাড়া করা ছোট্ট ঝুপড়িতে বসবাস করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। গোটা পাড়া সরেজমিনে ঘুরলেই এদের দুরাবস্থার চিত্র ভেসে ওঠে।

ঘরগুলোর চালা ভেঙ্গে পড়ছে। ঘরের আশপাশ ময়লাজঞ্জালে পরিপূর্ণ। তিনবেলা ভাত জোটানোই যেখানে মুশকিল, সেখানে ঘর মেরামতের সুযোগটা তাদের হয়ে ওঠে না।

বড় কুমিরার জলদাস পাড়ায় কেবল ভোরের আলো ফুটেছে। ঘরের পাশে নারীরা থালাবাসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত। কিছু পুরুষেরা বাইরে কাজে ছুটছে, আবার কেউ ঘুম ঘুম চোখে ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। পাড়ার ভেতরে ছোট গলি পথে শিশুদের দৌড়াদৌড়ি। কেউবা মায়ের আঁচল ধরে বসে আছে।

অপরিচিত লোক দেখে কাজ করতে করতেই আবার কয়েকজন নারীর উচ্চারণ, ‘ছবি তুইলা কী অইবে। আমাগো লাই কেউ তো কিছু নিয়ে আসে না। ’ অনেকটা বিরক্তির সুর তাদের কণ্ঠে। পুরুষেরা বাইরে কাজ করতে পারুক বা না পারুক, সব বোঝা ঘরের নারীর ওপরই এসে পড়ছে। সে কারণেই হয়তো তাদের এই বিরক্তি প্রকাশ।

নেপাল জলদাস, মঙ্গল জলদাস, হিমাংশু জলদাস, বাবুল জলদাসসহ যার সঙ্গেই কলা হয়েছে সবাই দাদনের জালে বন্দী হয়ে আছে যুগের পর যুগ। মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য মহাজনের কাছে হাত বাড়ান তারা। পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩-৪ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন নেন তারা। মাছ ধরে এই দাদন শোধ করতে হয়। কিন্তু জেলেরা মাছ না পাওয়ায় এবং বার বার জলদস্যুদের আক্রমণের মুখে পড়ে এই জলদাস সম্প্রদায় দাদনের দায়মুক্ত হতে পারছে না।

পাড়ার বায়ান্ন বছর বয়সী জেলে নেপাল জলদাস মাছ ধরার পেছনের ইতিহাস তুলে ধরে বলছিলেন, এক সময় সমুদ্রে মাছ পাওয়া যেত প্রচুর; কিন্তু মাছের দাম পাওয়া যেতো না। এখন মাছ পাওয়া যায়  না; কিন্তু মাছের দাম অনেক বেশি। দুর্যোগ আর জলদস্যুদের আক্রমনে সবই হারাতে হয়েছে। এখন আর মাছ ধরতে যেতে পারছেন না নেপাল।

হিমাংশু জলদাস জানাচ্ছিলেন, দশ বছর আগেও এখানে মাছের ব্যবসা জমজমাট ছিল। কুমিরা মাছঘাটে সকাল থেকে অধিক রাত পর্যন্ত বহু মানুষের ভিড় থাকতো। এখানের মাছ চলে যেত দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মাছের গন্ধে বাজারে বসা যেত না। বড় বড় ঝুড়িতে করে মাছ আনা হতো। সে দিন তো ফুরিয়ে গেছে।

জলদাস সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা জানালেন, সময়ের বিবর্তনে এখানকার লোকজনের অবস্থা বদলেছে। আগে সম্প্রদায়ের শিক্ষার হার ছিল শূণ্যের কোটায়; কিন্তু এখন সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের অনেক ছেলেমেয়ে শিক্ষার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অনেকে অনেক কষ্টে সন্তানের লেখাপড়া অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এক পর্যায়ে সে লেখাপড়া আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। আবার অনেকে লেখাপড়া করেই বিপাকে, কারণ চাকরি নেই।

যারা কষ্ট করে অনেকদূর লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছে সেইসব জলদাস সন্তান এবং যারা অধিক শ্রমে অর্জিত লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন, সেই অভিভাবকেরা আক্ষেপ করে বলেন, আমরা কী অপরাধ করেছি? আমাদের প্রতি এত বৈষম্য কেন? আমরা কী এদেশের মানুষ না?

জলদাস পাড়া ঘুরে এখানকার মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে বোঝা গেলো, এখানকার কিছু পরিবার বিভিন্ন উপায়ে ব্যবসা বানিজ্য করে অর্থকড়ি জগিয়েছে, ছিটেফোটা পাকা ঘরও উঠেছে তাদের। কিন্তু অধিকাংশের অবস্থাই আগের অবস্থায় রয়ে গেছে। পৈত্রিক পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতে ইচ্ছুক জালদাসদের মাছ ধরার সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেক পরিবারের ছেলেরা শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিকের কাজ করছে। তবে এ কাজ অধিক কষ্টকর হওয়ায় আনেকেই আবার নিরুৎসাহিত।  

ভর দুপুরে সীতাকুণ্ডের বাধের ওপর দাঁড়িয়ে একমনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রবীণ জলদাস নাগরিকেরা। তাদের ভাবনা একটাই, যে সমুদ্র তাদেরকে ব্যস্ত রাখতো সারা মৌসুম, সেই সমুদ্রই তাদের জীবনের আলো নিভিয়ে দিচ্ছে!   

বাংলাদেশ সময়: ০২০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।