ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

নির্বাচনবিহীন এক যুগ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৪
নির্বাচনবিহীন এক যুগ!

বড়বাইশদিয়া, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: লড়াইটা ইউনিয়নের বিভক্তি নিয়ে। একপক্ষের দাবি ঐতিহ্যবাহী ছোট্ট ইউনিয়ন আর ভাগ হতে দেওয়া যাবে না; আরেক পক্ষ বলছে দুভাগ করেই উন্নয়ন-সম্ভাবনা বিকাশের পথ সুগম করা সম্ভব।

দুই প্রান্ত থেকে দুই পক্ষের রশি টানাটানিতে উপকূলের একটি দ্বীপ ইউনিয়নে নির্বাচন হচ্ছে না দীর্ঘ এগারো বছর ধরে। ফলে উন্নয়নে পিছিয়ে আছে এলাকাটি, ভোটারদের মাঝে বাড়ছে ক্ষোভ।

এই ইউনিয়নটির নাম বড় বাইশদিয়া। ভয়াল আগুনমুখা নদীর বাঁকে রামনাবাদ আর দারছিড়া নদীর তীর ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ‘কলা’ আকৃতির এই ছোট্ট ভূখণ্ডটি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার আওতাধীন। প্রতিনিয়ত ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে জেগে থাকা এখানকার মানুষের দাবি একটা নির্বাচনের। ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তারা পেতে চান সব নাগরিক অধিকার।

ইউনিয়নের দক্ষিণপ্রান্তে মৌডুবি অংশের বাসিন্দাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বড়বাইশদিয়া থেকে বিভক্ত করে মৌডুবি নামে নতুন ইউনিয়ন করার গেজেট প্রকাশ হয়েছে প্রায় দুবছর আগে। এই গেজেটের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে নবগঠিত ইউনিয়নের কার্যক্রম স্থগিত থাকে। আর এই প্রক্রিয়ায় বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের নির্বাচনও বন্ধ থাকে। নেতৃস্থানীয়রা আইনি লড়াইয়ে ব্যস্ত, আর সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি চরমে।  

ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র তক্তাবুনিয়া বাজারে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। এই এলাকার মানুষ ইউনিয়ন বিভক্তি না হওয়ার পক্ষে। চিত্রশিল্পী মো. শাহ আলম, ব্যবসায়ী রিপন হাওলাদার, চাষি কবির হোসেনসহ অনেকেই বললেন, এরআগে এই ইউনিয়ন ভেঙ্গে চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি এলাকায় নদীভাঙনে ইউনিয়নের আয়তন কমছে। আবারও বিভক্ত হলে ঐতিহ্যবাহী এই ইউনিয়নটি অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। বিভক্তি নিয়ে আইনি জটিলতা মিটিয়ে ইউনিয়নের নির্বাচনের দাবি তাদের।     

তক্তাবুনিয়া, মণিপাড়াসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন জানান, ইউনিয়নের বড়বাইশদিয়া ও টুঙ্গিবাড়িয়া মৌজা ডিগ্রী নদী ও আগুনমুখা নদীর ভাঙনের মুখে। শত শত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। জেলে, চাষি ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণির মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে বসবাস করছে। এক শ্রেণির প্রভাবশালী লবণ পানি ঢুকিয়ে কৃষিজমি ফসল শুন্য করে ফেলেছে। বহু চাষি চাষাবাদ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। ইউনিয়নের এই জটিলতা নাগরিক সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পরিষদের নির্বাচন না হওয়ায় অভিযোগ জানানোর কোন জায়গা তাদের থাকছে না।

ইউনিয়নের কেন্দ্রে অবস্থিত এলাকার মানুষের দাবি, ইউনিয়ন বিভক্ত না করে নির্বাচন, আর অন্যপ্রান্তে মৌডুবি এলাকার মানুষের দাবি বিভক্ত করার পরে নির্বাচন। ওই এলাকার মানুষ বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে চান না। পৃথক নির্বাচনের দাবি তোলার পর ২০০২ সালে সর্বশেষ বড়বাইশদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মৌডুবি এলাকার মানুষ ভোটদান থেকে বিরত থাকে। ফলে পুনরায় নির্বাচন দিতে হয়। ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।  

পৃথক ইউনিয়নের দাবিতে সোচ্চার মৌডুবি এলাকার বাসিন্দাদের দাবি অনুযায়ী, ছাতিয়ানপাড়া ও কানকুনিপাড়ার দক্ষিণ সীমানা থেকে কাজিকান্দা, মৌডুবি, মুখারবান্ধা, আশাবাড়িয়া, চর হেয়ার, চর বগলা, গণিরচর এবং চর তুফানিয়া নিয়ে গঠিত হবে মৌডুবি নামের নতুন ইউনিয়ন। প্রায় ২০ হাজার লোকসংখ্যা অধ্যুষিত এই ইউনিয়নে ভোটার হবে প্রায় ১০ হাজার। এই এলাকা ও লোকসংখ্যা নিয়ে ইউনিয়নের দাবি কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয় বলে দাবি তাদের।

মৌডুবি ইউনিয়নের দাবির পক্ষে নেতৃত্বদানকারী মৌডুবি গ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ শিক্ষক মো. সাহাবুদ্দিন দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে বাংলানিউজকে বলেন, সমুদ্রের মোহনায় জেগে থাকা এ-এলাকায় রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রশাসন থেকে অনেক দূরে অবস্থানের কারণে সেসব সম্ভাবনা বিকশিত হচ্ছে না। এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক জেলের মৎস্য আহরণের মধ্যদিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় হচ্ছে। সমুদ্র মোহনায় অবস্থিত জাহাজমারা সৈকত, চর তুফানিয়া, চর হেয়ার আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে। এসব সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতেই মৌডুবিতে ইউনিয়ন প্রয়োজন।
          
বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ হানিফ মিয়া বলেন, ইউনিয়ন ভাগ হয়ে দুই ইউনিয়নে পরিণত হয়েছিল। গেজেটও বেরিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বারবার মামলা করে ইউনিয়ন ভাগাভাগি বন্ধ করে রেখেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান। এর ফলে একযুগেও এ ইউনিয়নে নির্বাচন হয়নি। যাতে আরও ২০-২৫ বছর নির্বাচন না করে ক্ষমতায় থাকা যায়, সে চেষ্টাই চলছে।

সূত্র বলছে, রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের নির্বাচিত পরিষদের বয়স যুগ পূর্ণ হতে চলেছে। ২০০২ সালের পর এখানে নির্বাচন হয়নি। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়নবাসী ও একযুগ ধরে চেয়ারম্যান পদ আঁকড়ে থাকা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হাসানাত আব্দুল্লাহর সমন্বয়ে বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নকে ভাগ করে মৌডুবি ও বড়বাইশদিয়া নাম দিয়ে ২টি ইউনিয়ন গঠন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রথমদিকে ইউপি চেয়ারম্যান এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন। পরবর্তীকালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তা দীর্ঘস্থায়ী করতে সীমানার জটিলতা দেখিয়ে আদালতে রিট করে প্রকাশিত গেজেট স্থগিত করান। এলাকাবাসীর দাবি, একমাত্র চেয়ারম্যানের কারণেই বিষয়টি ঝুলে আছে।

ভোটাররা বলছেন, বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররা দুই মেয়াদেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্বে রয়েছেন। জনগণের কাছে তাদের নেই কোনো জবাবদিহিতা। বর্তমান চেয়ারম্যানকে ‘অনির্বাচিত’ দেখিয়ে তার সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারদলীয় লোকজন হাতিয়ে নিচ্ছে ইউনিয়নের বিভন্ন প্রকল্প। লুটপাট চলছে এলাকার হতদরিদ্র মানুষের জন্য দেওয়া ভিজিডি-ভিজিএফ, চল্লিশদিনের কর্মসূচি, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, কাবিখা, টিআর কর্মসূচিতে।

এ বিষয়ে জানতে বাংলানিউজ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু হাসানাত আব্দুল্লাহ’র সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছে। একাধিকবার তক্তাবুনিয়া বাজারে অবস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে গিয়ে কার্যালয় বন্ধ পাওয়া গেছে। বিশেষ প্রয়োজন না হলে চেয়ারম্যান এলাকায় আসেন না বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পরে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।