ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

ইলিশ সাম্রাজ্যই ইলিশের কাঙাল!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৩ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৬
ইলিশ সাম্রাজ্যই ইলিশের কাঙাল! ছবি- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নিঝুম দ্বীপ থেকে: ১৯৩৬ থেকে ২০১৬ সাল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস প্রকাশ থেকে বর্তমান সময়।

কেটে গেছে আট দশক। উপন্যাসটিতে মানিক জেলেপল্লীর যে নিদারুণ কষ্টের উপাখ্যান তুলে ধরেছিলেন; দেশ স্বাধীন হওয়া থেকে শুরু করে ডিজিটালের ছোঁয়ায় অনেক কিছু বদলালেও, বদলায়নি সেই জেলেদের ভাগ্য। আজও তারা অবহেলিত, ইলিশের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত।

আজও পানি ও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে ইলিশ ধরা জেলেদের পাতেই ওঠে না ইলিশ। অথচ তাদের ধরা ইলিশই বিশ্বব্যাপী দেশের নাম উজ্জল করছে।

মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত নিঝুম দ্বীপের প্রত্যেক জেলেই যেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কুবের। যে চরিত্রের মাধ্যমে মানিক তুলে ধরেছিলেন জেলেপল্লীর নিদারুণ কষ্টের উপাখ্যান।

নিঝুম দ্বীপের কয়েকটি গ্রাম ও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার জেলেদের জালে প্রতিদিন হাজারে হাজারে ইলিশ ধরা পড়ে। অথচ এসব মাছ ধরা জেলে ও বাসিন্দাদেরই ইলিশ খাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। যেন ইলিশের সাম্রাজ্যই ইলিশের কাঙাল।

মহাজনদের দাদনের (ঋণের) কঠিন শর্তের আবর্তে ইলিশ শূন্য থাকে জেলেদের ভাতের পাত। দ্বিগুণ দামেও তারা সন্তানদের প্লেটে তুলে দিতে পারেন না তাদেরই ধরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ।
 
নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার এলাকার জেলে মো. আশরাফ বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইলিশের মৌসুম শুরু হয়েছে। জালে মাছও পড়ছে। সেসব মাছ প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে মহাজনের আড়তে বিক্রি করি। ধরা মাছ থেকে খাওয়ার জন্য কিছু পাই ঠিকই, তবে সব সময় মহাজনের অনুমতি মেলে না। ইলিশের পরিবর্তে কম দামি মাছই বাড়ির জন্য আনতে হয়’।

এখানকার সব জেলেই ইলিশ মৌসুমে মাছ ধরার জন্য মহাজনের কাছ থেকে ‘দাদন’ নিয়ে থাকেন। দাদনের শর্ত অনুযায়ী জেলেদের ধরা সব মাছ বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে মহাজনের কাছেই বিক্রি করতে হয়। বিক্রির ১০ শতাংশও বাধ্যতামূলকভাবে মহাজনকে দিতে হয়। নিজেদের খাওয়ার জন্য মাছ নেওয়ারও নিয়ম নেই। তবে কালে-ভদ্রে কপালে জোটে দুই-একটি জাটকা।

বেসরকারি সোলার কোম্পানির বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে নিঝুম দ্বীপে বসবাসরত দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘পুরো রমজান মাসে একটি ইলিশও কিনতে পারিনি। কারণ, নদী থেকে মাছ ওপরে তোলার পর তা চলে যায় মহাজনের আড়তে। সেখান থেকে কিনতে হলে দ্বিগুণ দাম দিতে হয়। অথচ তারা জেলেদের কাছে থেকে এর অর্ধেক দামে কিনে নিচ্ছেন’।

সাগড় পাড়ের ১২ বছর বয়সী শিশু রনি জানায়, তার বাবা সাগরে ইলিশ ধরলেও তাদের বাড়িতে এ মৌসুমে এখনও ইলিশ রান্না হয়নি। নদীর ইঁচাগুড়া (ছোট চিংড়ি), পাঙ্গাস বা বাজারের তেলাপিয়াই বেশি রান্না হয়।
 
কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘ইলিশ তো দামি মাছ, ওটা মহাজনকে দিতে হয়। এটাই নিয়ম’।

জেলে মো. ইকবাল জানান, একটি নৌকায় ১০-১৫ জন জেলে মাছ ধরেন। নৌকার মালিক মহাজনের কাছ থেকে ‘দাদন’ নিয়ে জেলেদের মধ্যে বিতরণ করেন। প্রতিদিন পাওয়া মাছ বিক্রির টাকা সমান দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। যার পুরো এক ভাগ নৌকার মালিক বা মাঝি পান। অন্যভাগ থেকে নৌকার ভাড়া দেওয়ার পরে বাকিটা অন্য জেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই টাকা থেকে জেলেরা মাঝির কাছ থেকে নেওয়া ‘দাদন’ পরিশোধ করেন। আর মাঝিও আড়তদারের কাছে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য। কারণ, তিনিই মহাজনের কাছ থেকে ‘দাদন’ নিয়ে জেলেদের দিয়ে থাকেন। তাই এসব ক্ষেত্রে ইলিশ পাওয়া এবং তার যথাযথ হিসেব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি বিষয়।  

জেলে ও মাছ শিকারিদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে কেনা মাছই ঢাকাসহ সারাদেশে দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করেন আড়তদাররা।
 
নিঝুম দ্বীপের আড়তদার কেফায়েত উল্লাহ জানান, গত তিন দিনে তার নৌকায় ২৬০টি ইলিশে উঠেছে। যার বাজার দর প্রায় ৯০ হাজার টাকা। তবে এগুলো কয়েকগুণ বেশি মূল্যে ঢাকায় বিক্রি হবে।
 
কয়েকজন জেলে বলেন, ‘আমাদের ইলিশ ধরতে হয়, বেচতে হয়। কিন্তু খেতে হয় না। এটা আমাদের সন্তানরাও জানে’।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৬
জেপি/টিআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad