ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

রাসমেলার আড়ালে

সুন্দরবনে অবাধে গাছ কাটা ও হরিণ শিকার

জেসমিন পাপড়ি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৫
সুন্দরবনে অবাধে গাছ কাটা ও হরিণ শিকার ছবি: কাশেম হারুন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দুবলার চর (সুন্দরবন) থেকে ফিরে: রাসমেলার দর্শনার্থী হিসেবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে অবাধে সুন্দরবনের বৃক্ষ নিধন ও হরিণ শিকার করেছেন একদল শিকারি। বন বিভাগের কড়া নজরদারির পরেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন এসব চোরাশিকারিদের কবলে পড়েছে।


 
সাগরকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় উৎসব রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গোপসাগরের কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে ওঠা দুবলার চর দ্বীপে। হাজার হাজার দর্শনার্থীদের সঙ্গে পেশাদার চোরা শিকারিরাও  মেলার সময় সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। এরপর সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতে চালান বৃক্ষ ও হরিণ নিধনযজ্ঞ। এছাড়া বনের ভেতরে উচ্চশব্দে মাইক বাজানোর পাশাপাশি নানাভাবে বনের নির্মল পরিবেশকে বিষিয়ে তোলেন দর্শনার্থীরা।
 
সুন্দরবনে প্রবেশের আগে স্থানীয় ফরেস্ট অফিস থেকে প্রত্যেক ট্রলারকে পাশ সংগ্রহ করতে হয়। রাসমেলা উপলক্ষে তিনদিন পর্যন্ত বনে থাকার অনুমতি দেয় বন বিভাগ। তিনদিনের প্রয়োজনীয় পরিমাণ জ্বালানি কাঠ মজুদ রেখে সুন্দরবনে প্রবেশের নিয়ম থাকলেও তা না রেখে বনে জ্বালানি সংগ্রহে নামেন প্রত্যেক নৌ-যানের দর্শনার্থীরা। বন বিভাগের অনুমতি পেতে ট্রলারে গ্যাসের ব্যবস্থা থাকলেও বনে ঢুকে কার্যত গ্যাসের চুলা অব্যবহৃতই থেকে যায়। সামান্য চুলা জ্বালাতেই সুন্দরবনে ঢুকে সুন্দরী, গরান, ধুন্দলের মূল্যবান গাছ কাটতে দেখা যায়। এছাড়া সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে শিকারিরা নামেন বনের মায়াবি চিত্রল হরিণ নিধনের মহোৎসবে।

শিকারের জন্য বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিতে না পারলেও বন বিভাগের নজর এড়িয়ে নাইলনের ফাঁদ, জাল, স্প্রিং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, বড়শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদসহ পাতায় ব্যবহার করা চেতনানাশক ওষুধ নিয়ে যান শিকারিরা। বন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে বনে ঢুকে এসব ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে থাকেন তারা। এসব ফাঁদে হরিণ ধরা পড়লে আড়ালে থাকা শিকারিরা ছুটে গিয়ে হরিণকে লাঠিপেটা করে মেরে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে জবাই করেন। বনের ভেতরেই চলে এই মাংস বেচা-কেনা।

বন বিভাগের পাশ নিয়ে বনে প্রবেশের কয়েক ঘণ্টা  পর থেকেই সক্রিয় হতে দেখা যায় এসব শিকারিদের। শিকারের সুবিধার জন্য অনেক ট্রলারকে সঙ্গে ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে বনে প্রবেশ করতে দেখা যায়। একাধিক শিকারির সঙ্গে কথা কলে জানা গেছে, সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, আলোর কোল, কটকা, কচিখালী, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালী, তালপট্টিসহ অভয়ারণ্য ঘোষিত বিভিন্ন এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণ বিচরণ করে। তাই শিকারের জন্য এসব অঞ্চলকে বেছে নেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিকারি বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় রাসমেলার সময়টাতেই আমরা শিকারিরা বনে আসি। অন্য সময়গুলোতে অভয়ারণ্যগুলোর কাছাকাছি যাওয়ার অনুমতি মেলে না। দর্শনার্থীদের ট্রলারগুলো হরিণের মাংস ও কাঠ সাপ্লাই দেওয়ার চুক্তিতে আমাদেরকে নৌকায় নিয়ে থাকে।

মাদার নদী দিয়ে কৈখালী ফরেস্ট স্টেশন হয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করা ট্রলারগুলো কাগা দোবেকি পার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই বিভিন্ন খালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকে। এ সময় তীরে ট্রলার থামিয়ে কাঠ কাটতে দেখা যায় তাদের। একদল নদীর পাড়ে পড়ে থাকা শুকনো কাঠ সংগ্রহ করেন। অন্যদল ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করে কেটে আনেন মূল্যবান সব গাছ। এ সময় তাদেরকে সুন্দরী, ধুন্দল, কেরোসিন কাঠের মতো দুর্লভ গাছও নির্দ্বিধায় কেটে আনতে দেখা যায়।

সুন্দরবন থেকে ফেরা একটি ট্রলার থেকে ভেটখালী বাজারে কয়েকটি সুন্দরী কাঠ নামাতে দেখা যায়। বন থেকে গাছগুলো আনেন শহিদুল ইসলাম।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য গাছটি আনিনি। গাছগুলোর যে সাইজ তা বড় কোনো কাজেও লাগানো যাবে না। সুন্দরী খুবই মূল্যবান কাঠ, গভীর সুন্দরবন ছাড়া পাওয়া যায় না। বন থেকে গাছ কাটা কষ্টকর নয়। কিন্তু বন কর্মকর্তাদের নজর এড়িয়ে এ পর্যন্ত আনাটাই বড় কষ্টকর। শেষ পযর্ন্ত সেটা আনতে পেরেছি। তবে বড় এবং সংখ্যায় বেশি গাছ কেটে আনা সম্ভব নয়।

ট্রলারের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতেও অবাধ এসব গাছ কাটতে দেখা যায়।

কৈখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা এফ এম জামাল বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর। চোরা শিকারি দমনে বন বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। রাসমেলা উপলক্ষে যে ট্রলারগুলোকে বনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, নির্দিষ্ট সময় পর গুনে গুনে সেগুলোকে বন থেকে বের করে আনা হয়েছে। এছাড়া যাওয়া-আসার প্রতিটি পথে বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের কড়া পাহারা ছিল। তাই শিকারিরা খুব বেশি সুবিধা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, ট্রলারগুলো চলতি পথে নদীর কিনারায় থেমে যেতেই সেখানে হাজির হয়েছে বন বিভাগের স্পিডবোট। বন কর্মকর্তারা থামার কারণ জানতে চেয়েছেন। সেখানে কৈফিয়ত দিয়ে পার হয়ে এসে বনের অন্য কোনো অংশে ঢুকে যায় সেসব ট্রলার। তবে জনবলের অভাবে এ সময় একসঙ্গে সুন্দরবনে প্রবেশ করা শত শত ট্রলারের পিছু নেওয়া সম্ভব হয় না বন বিভাগের। জনবল আর রসদের এ অভাব  স্বীকার করলেন তারা।

তবে শুধু রাসমেলাকে কেন্দ্র করেই নয়, সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা, পাইকগাছা, শ্যামনগর, মুন্সীগঞ্জ, নওয়াবেকি, কৈখালী, ভেটখালী, কালিঞ্চি, কাশিমারিসহ প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অন্যান্য সময়েও পাওয়া যাচ্ছে হরিণের মাংস। এসব এলাকায় কেজিপ্রতি মাত্র তিন থেকে চারশ’ টাকায় হরিণের মাংস পাওয়া যায়। যে কারণে সুন্দরবনের হরিণের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে আসছে বলে জানান স্থানীয়রা।  

** অপসংস্কৃতি বিষিয়ে তুলেছে সুন্দরবনের নির্মলতা
** সুন্দরবনে আরও ২ র‌্যাব ক্যাম্প হবে
** ‘কাজের মেয়ে’ নয়, ওরা এখন স্কুলে যায়
** ওই যায় হেলিকপ্টার...
** বন বিভাগের অনুমতি নিতেই রাত পার

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৫
জেপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।