ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

স্বাস্থ্যসেবায় দৃষ্টান্ত গড়েছে চর ফলকন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৪
স্বাস্থ্যসেবায় দৃষ্টান্ত গড়েছে চর ফলকন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কমলনগর, লক্ষ্মীপুর ঘুরে এসে : ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ ভবনটিতে এখন আলো ঝলমল পরিবেশ। যে ভবনে ঢুকতে এক সময় মানুষ ভয় পেত, সেখানে এখন নবজাতকের নিরাপদ আগমন ঘটে।

নারী-পুরুষ শিশু স্বাস্থ্যসেবার ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে কেন্দ্রটি। ওষুধ আছে, চিকিৎসক আছে, আর তাই রোগীর ভিড়ও বাড়ছে দিনে দিনে।  

উপকূলের জেলা কমলনগরের স্বাস্থ্যচিত্রের চরম দুরাবস্থার মাঝে এক টুকরো আশার আলো চর ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। এটাকে এখন আর কেউ পরিত্যক্ত ভবন বলে না। একটা সময় ছিলো যখন এখানে চিকিৎসক ছিল না, পাওয়া যেত না ওষুধ। সন্তান প্রসব তো দূরের কথা, প্রাথমিক চিকিৎসায় প্যারাসিটামল ট্যাবলেটটি পর্যন্ত মিলতো না। ছিল না বসার স্থানও। আর এখন শুধু চর ফলকন ইউনিয়ন নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও চিকিৎসার জন্য মানুষ ছুটে আসে এখানে।  

সরেজমিন ঘুরে চোখে পড়ে, কমলনগর উপজেলার স্বাস্থ্যচিত্রের যে বেহাল দশা পাঠককে জানিয়েছে বাংলানিউজ, তার পুরোপুরি উল্টোচিত্র এখানে। চিকিৎসক ব্যস্ত রোগী দেখায়। অপেক্ষমাণ রোগীরা বসে আছে বেঞ্চে। নবজাতক প্রসবের কক্ষ সাজানো-গোছানো পরিপাটি। কেন্দ্রের পুরানো ভবনটি যেভাবে সংস্কার করা হয়েছে, তাতে বোঝার কোন উপায় নেই এটা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।  
 
কেন্দ্রে আসা রোগীরা জানালেন, এই এলাকায় সন্তান প্রসব থেকে শুরু করে অন্যান্য জটিল সমস্যায় মানুষ চরম বিপাকে পড়তো। এখন সে সমস্যা কেটে গেছে। গোটা কমলনগর উপজেলা শুধু নয়, এখন পাশের উপজেলা রামগতি থেকেও বহু রোগী এই কেন্দ্রেই ভরসা খোঁজেন। শুধু দিনে নয়, রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী, এখানে গভীর রাতে সন্তান প্রসব হয়।    
 
স্থানীয় সূত্র বলছে, মেঘনার ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাসহ সব দিক থেকেই পিছিয়ে ছিল চর ফলকন ইউনিয়ন। ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবা নিশ্চিত করতে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৮২ সালে। কিন্তু জনবল না থাকায় ওই কেন্দ্রের সেবা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, কেন্দ্রে ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, ভিজিটর নিয়োগ দেয়া হলেও তারা পরিবেশ না থাকায় প্রেষনে অন্যত্র দায়িত্ব পালন করতেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কার্যক্রম চালু না থাকায় চর ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি জনবল শূন্যতায় পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছিল। গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্বকাল এবং প্রসবকালীণ সেবার সুযোগ না থাকায় মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু প্রকট আকার ধারণ করে দুর্গম এই জনপদে।

বদলের সূচনা ঘটে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে। লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট এলজিএসপি-২ থেকে পাওয়া বরাদ্দ দিয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সড়ক, ভবন ও টয়লেট মেরামত, বৈদ্যুতিক ও পানি সরবরাহ উন্নয়ন, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। মা-মনি প্রকল্প থেকে দু’জন প্যারামেডিক্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে ২০ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্ব এবং প্রসবকালীন সেবায় অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই পরিবর্তনের কৃতিত্বে মা-মনি এইচএসএস প্রকল্প এবং চর ফলকন ইউনিয়ন পরিষদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথাই স্মরণ করলেন বার বার।   

কেন্দ্রে দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, চলতি বছরের মার্চে চর ফলকন ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড সভায় স্বাস্থ্যকর্মী শাহাদাত হোসেন কেন্দ্রের সমস্যা তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, মা-মনি প্রকল্পের আওতায় সেভ দ্য চিলড্রেন চর ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গর্ভবতী  মায়েদের মাতৃকাল সেবা প্রদানে ২ জন প্যারামেডিক্স নিয়োগ করেছে। কিন্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি পরিত্যক্ত হওয়ায় এবং পরিবেশ না থাকায় সেবা দেয়া করা যাচ্ছে না। সভায় চর ফলকন গ্রামের সমাজকর্মী সেলিনা আক্তার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সড়ক, টয়লেট ও ভবন মেরামত, বৈদ্যুতিক, মেডিকেল যন্ত্রপাতি-আসবাবপত্র ও পানি সরবরাহ উন্নয়নে স্বাস্থ্যখাতের সকল বরাদ্দ দিয়ে কেন্দ্রটি সচল করার প্রস্তাব আনেন।  

এর পরপরই ইউনিয়ন পরিষদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নেয়। বাস্তবায়ন করে দুই লক্ষ সাত চল্লিশ হাজার আট শত সতের টাকার প্রকল্প।

অন্যদিকে ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন ও ডিএসকে মা-মনি এইচএসএস প্রকল্পের সেবা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়। ওই প্রকল্প ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জনবল নিয়োগ ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্বকাল ও প্রসবকালীস এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানে এগিয়ে আসে। এই দু’য়ে মিলে চর ফলকনে স্বাস্থ্যসেবার এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে।   


এর পরের গল্প পরিবর্তনের। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও উন্নয়নে খুব দ্রুতই বদলাতে থাকে পিছিয়ে পড়া জনপদ চর ফলকন। যে এলাকার প্রসূতি 
মায়েদের দূরবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব ছিল না, সে এলাকার মানুষ এখন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে হাতের কাছেই।   

এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, এক সময় এখানকার প্রসূতি মায়েদের দূরবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে নিয়ে সেবা পাওয়া সম্ভব ছিল না। চর ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এখন কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ৫ লাখ অধিবাসীর জন্য গর্ভবতী মায়েদের নিরাপদ প্রসবের একমাত্র স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন এলাকা ও পাশ্ববর্তী এলাকা তথা কমলনগর ও রামগতি উপজেলার প্রসূতি মায়েরা নিরাপদ প্রসব এবং মাতৃত্বকালীন সেবার জন্য দূর দূরান্ত থেকে এখানে আসেন সেবা নিতে।  

কেন্দ্রটিতে এমবিবিএস ডাক্তার, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, ভিজিটর, দু’জন প্যারামেডিক্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল পালাক্রমে দায়িত্বপালন করছেন।  

স্থানীয় সমাজকর্মী নাজিম উদ্দিন বলেন, ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামসহ কমলনগর ও রামগতি উপজেলার প্রসূতি মায়েদের নিরাপদ প্রসব এবং মাতৃত্বকাল সেবার জন্য এখন ভরসা চর ফলকন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। দুই উপজেলার অন্তত ৫ লাখ মানুষ এখন এই কেন্দ্র থেকেই চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ মাত্র এক বছর আগেও এটা সম্ভব ছিল না।  

৫নং চর ফলকন ইউপি চেয়ারম্যন এ এন এম আশরাফ উদ্দিন জানান, ১৯৮২  সালে ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবার জন্য একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও তাতে জনবল না থাকায় এলাকাবাসী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। মা-মনি এইচএসএস প্রকল্প এবং ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্যসেবার পরিবর্তন ঘটেছে। ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ গর্ভবতী মায়েদের মাতৃত্ব এবং প্রসবকালীন সেবা নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত।  

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়:  [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।