ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

দেয়ালবন্দি মল্লিকপুরের বিশ্ব বট

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৪
দেয়ালবন্দি মল্লিকপুরের বিশ্ব বট

ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থেকে মোটরবাইকে যাত্রা শুরু। দেখতে যাচ্ছি আমাদের বিশ্ব বট।

সেখান থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে মল্লিকপুর। পিচঢালা এ সরু পথটির নাম কালিগঞ্জ-আড়পাড়া-খাজুরা সড়ক। দু’পাশে সবজির মাচা। হঠাৎ দু’একটি পানের বরজ। কোথাও কোথাও দিগন্ত জোড়া শস্যের মাঠ। এসবের ফাঁকগলেই চোখে পড়ে দু’চারটি খেজুরের বীথি।

বাইকের গতি কমে এলে দেখি সামনে কয়েকটি দোকানপাট, ছোট্ট একটা বাজারের মতো। চলে এসেছি কাঙ্ক্ষিত বিশ্ব বটের সীমানায়। মল্লিকপুরের এই গ্রামটির নাম বেথুলী, ইউনিয়ন মালিয়াট। স্থানীয়দের কাছে সুইতলা নামেও পরিচিত।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, একসময় দূরগ্রামের পথিকেরা এই গাছের ছায়ায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিতেন। আর তাই এমন নামকরণ। চারপাশ সংক্ষিপ্ত দেয়ালে ঘেরা। তারমানে গাছটির ভবিষ্যত নির্ধারিত, তাকে আর বাড়তে দেওয়া হবে না। দেয়ালটি গাছের নিরাপত্তার কথা ভেবে তৈরি হলেও সেটাই যেন তার সীমারেখা।

শুয়ে থাকা ডালপালার পাশঘেঁষে ভেতরে ঢোকার পর কিছুটা হতাশ হই। আমাদের কল্পিত নিশ্ছিদ্র বুননের সেই বট নয় এটি। বরং যেন হতশ্রী, জ্বরাগ্রস্ত কোনো এক ক্লান্ত বৃক্ষের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি। মনে হলো নিকট ভবিষ্যতে সে মৃত্যুর জন্যও প্রস্তুত! অথচ দেশজুড়ে তার কতো খ্যাতি।

এই মহীরুহের জন্ম কখন, কীভাবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে তার জন্ম সেই চিরাচরিত নিয়মে।

কোনো পাখিই তার বীজটা বুনে দিয়েছিল এই উন্মুক্ত প্রান্তরে। তাও প্রায় দু’শতোর্ধ্ব বর্ষ আগেকার কথা। ধীরে ধীরে বিস্তৃত হতে হতে এখন তার আয়তন প্রায় ২ দশমিক ৩৩ হেক্টরে ঠেকেছে। মূল গাছ থেকে জন্মেছে প্রায় ৪৫টি উপবৃক্ষ। মোট ঝুরির ৩৪৫টি মাটির সঙ্গে যুক্ত এবং ৩৮টি ঝুলন্ত। অনেক আগেই হারিয়ে গেছে মূল কাণ্ডটি।

স্থানীয়দের মতে, একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এ গাছের ছায়ায় পূজা-অর্চনা করত। জনশ্রুতি রয়েছে, তারা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে একসময় এই বটের পাশে একটি পাকুড় রোপণ করে বট-পাকুড়ের বিয়ে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর পরিমাণে লোক সমাগম হয়। তাতে স্থানীয় জমিদারও উপস্থিত ছিলেন।

একসময় জায়গাটি ছিল একজন জমিদারের। নাগরিক সম্পৃক্ততার কারণেই ধীরে ধীরে তা খাস জমিতে পরিণত হয়। আগে গাছটি দেখভালের দায়িত্ব ছিল জেলা প্রশাসনের, হালে দায়িত্ব নিয়েছে বন বিভাগ। চারপাশে লোকালয় ও সড়কের কারণে থেমে গেছে এর বিস্তৃতি। স্থানীয়রা জানান, পথগুলো আরেকটু দূরে সরিয়ে নিলেও তেমন সমস্যা ছিল না। কারণ পথের কারণেই বাড়তি ডালগুলো প্রতিবছর কাটা পড়ছে। ফলে গত কয়েকবছরে গাছটির কোনো বৃদ্ধিই ঘটেনি।

সবচেয়ে আপত্তিকর কাজটি হচ্ছে মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় ভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো। এখন আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাছটির পূর্ণাঙ্গ শোভা উপভোগ করা যায় না। এমন দুর্বুদ্ধি যার মাথায় এসেছিল তাকে নিন্দাবাদ না জানিয়ে উপায় কী! মাঝখানটা ফাঁকা থাকলেই বা কি ক্ষতি। বরং চেষ্টাটা এমন হওয়া উচিৎ ছিল, চারপাশ থেকে ডালপালাগুলো এসে যেন শূন্যস্থানটা পূরণ করে দিতে পারে। তবে এখন আর তা সম্ভব নয়। তাছাড়া এখানে দর্শনার্থীদের জন্য কোনো তথ্য বোর্ডও নেই। অতি দ্রুত একটি নির্ভুল তথ্য বোর্ড টাঙানো প্রয়োজন। গাছটির যথাযথ সংরক্ষণের প্রয়োজনে পিকনিক পার্টিসহ সর্বসাধারণের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাও এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।   

এ প্রসঙ্গে কলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সংরক্ষিত বট গাছটির কথা বলা যায়। শিবপুরের গাছটির আয়তন প্রায় ১৪৪২৮.৪৪ বর্গ মিটার, মল্লিকপুরের গাছটির চেয়ে তুলনামূলকভাবে কিছুটা বড়। বয়স প্রায় দুশো পঞ্চাশের ওপরে। এই গাছটির চারপাশে বিস্তৃত হবার সুযোগ আছে, আমাদের গাছটির নেই। ডালপালাও যথেষ্ট সুবিন্যস্ত।

 চারপাশেই আয়তাকার ভঙ্গিতে ক্রমশ বাড়ছে। মাঝের কাণ্ডগুলোর চারপাশ রেলিং ঘেরা। সেখানে টাঙানো আছে কয়েকটি তথ্য বোর্ড। প্রতিদিন অনেকেই আসেন এই মহা বৃক্ষের সৌন্দর্য অবলোকন করতে। দুটি বটগাছের মধ্যে প্রধান ফারাক মল্লিকপুরের গাছটি একেবারেই প্রাকৃতিক। কিন্তু শিবপুর গার্ডেনের গাছটি নান্দনিকতার প্রয়োজনে নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত।

উদ্ভিদবিদ ওনিসর্গীরা জানান, এই মুহূর্তে মল্লিকপুরের গাছটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা প্রয়োজন। তা না হলে ক্রমেই ক্ষয় হতে থাকবে এর জীবনীশক্তি। ড. নওয়াজেশ আহমদ এ গাছটি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। তিনিও ভেতরের অনাকাঙ্ক্ষিত গাছপালা সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

তিনি মনে করেন, সেখানে শুধু সবুজ ঘাসের গালিচাই থাকতে পারে। তাহলে গাছটির অবয়ব ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সুসামঞ্জস্যতা বজায় থাকবে।

তিনি গাছটির স্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রয়োজনে চারপাশের পথগুলো সরিয়ে নেওয়ার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছিলেন। একই কারণে গাছটির আর কোনো ডাল যেন কাটা না হয় এ ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি। সঠিকভাবে সংরক্ষণ সম্ভব হলে এ গাছ আরো কয়েকশ বছর বেঁচে থাকবে।      

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad