ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ শকুন

তাবারুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৪
বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ শকুন

ঢাকা: শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ পাখি। ভাগাড়, নদীর কিনার, ময়লার স্তূপে পড়ে থাকা মরা-পঁচা প্রাণীসহ  বিভিন্ন বস্তু খেয়ে সহজে হজম করতে পারে এরা।

কিন্তু মানুষের ক্রমাগত অযত্ন, অবহেলা, অসচেতনতায় উপকারী এ পাখিটি এখন বিপন্নের তালিকায়।

পশু ইনজেকশন হিসেবে ব্যবহৃত কিটোপ্রোফেন ও নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক প্রয়োগ শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

প্রাণিবিজ্ঞানী ও শকুন গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শকুন হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী যে ওষুধটি তার নাম ‘ডাইক্লোফেনাক’। যে কারণে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শকুন।

বিশেষজ্ঞদের মতে,  দেশ থেকে দিন দিন অস্বাভাবিকহারে শকুনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে এরা যে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

শকুন কমে যাওয়ার কারণে অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা, খুরা রোগসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে শকুন বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বাংলানিউজকে বলেন, শকুন জীবিত কোনো প্রাণী খায় না। বড় বড় যে সব প্রাণী মরে রোগ-জীবাণু ছড়ায় সেসব প্রাণী খায় শকুন। অন্য সব প্রাণীই মৃত প্রাণী খেয়ে চারদিকে রোগ-জীবাণু ছড়ায়। শকুনই একমাত্র মৃত প্রাণী খেয়ে রোগ-জীবাণু হজম করতে পারে। ।

অস্বাভাবিকহারে শকুনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শকুন কমে যাওয়ার কারণে দেশে এখন অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা, খুরা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, এক সময় দেশে ৭ প্রজাতির শকুন থাকলেও রাজ ও সরুছুঁটি প্রজাতির শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলা শকুনও বিলুপ্তির পথে। উপমহাদেশে পাখি পরিবারের মধ্যে শকুনই একমাত্র প্রজাতি যা পৃথিবী থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

শকুন নিয়ে তেমন কোনো জরিপ নেই। এরপরও বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছেন, ১৯৭১ সালে দেশে প্রায় ৫০ হাজার শকুন ছিল। গত চার দশকে প্রায় ৯৯ ভাগ বাংলা শকুনই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। এখন দেশে শকুন আছে আনুমানিক শপাঁচেক।

ড.  মনিরুল বলেন, আমি শকুন নিয়ে চার বছর গবেষণা করেছি। এতে দেখা যায় দেশে বর্তমানে পাঁচশোটির মতো শকুন টিকে আছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সিলেট বিভাগ ও সুন্দরবন এলাকায় কিছু শকুন এখনও টিকে আছে। শকুন সংরক্ষণে এদের খাবার ও আবাসস্থল রক্ষার পাশাপাশি বাজার থেকে কিটোপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাকের মতো ক্ষতিকর ওষুধ বাজারজাত ও উৎপাদন বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

পশু চিকিৎসকরা ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন ইনজেকশনটি পশুর চিকিৎসায় ব্যবহার করেন। কোনো গরু যদি এই ইনজেকশনটি নেওয়া অবস্থায় মারা যায়, এরপর কোনো শকুনের দল যদি ওই মরা পশুর মাংস খায় তাহলে খুব দ্রুতই শকুনটি মারা পড়ে।

এর বিষাক্ততার কারণে ২০০৬ সালে পাকিস্তান ও ২০০৯ সালে নেপালে ডাইক্লোফেনাকের পরিবর্তে মেলোক্সিক্যামসহ অন্য বিকল্প ওষুধ ব্যবহার শুরু হয়।

জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার এ ওষুধটি ২০১০ সালে নিষিদ্ধ করলেও অবৈধভাবে কিছু কোম্পানি তা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া ডাইক্লোফেনাকের মতোই সমান ক্ষতিকর কিটোপ্রোফেন বাজার সয়লাব। প্রায় প্রতিটি ওষুধ কোম্পানিই এটি বাজারজাত করছে। এ ধরনের মাত্র ৩০ মিলিলিটার ওষুধে পাঁচশো শকুনের মৃত্যু হতে পারে।

ডাইক্লোফেনাকের মতো সমান ক্ষতিকর ওই ওষুধটিও নিষিদ্ধ করে বাজারজাতকরণ বন্ধ করলে শকুন রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইইউসিএন বাংলাদেশ ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বাংলা শকুন রক্ষায় একটি প্রকল্প চালু হয়েছে।

এ প্রকল্পের পরিচালক এবিএম সারওয়ার আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কিটোপ্রোফেন নিষিদ্ধ করা ও শকুনের জন্য সেফ জোন নির্ধারণ করতে প্রকল্পের আওতায় কাজ করা হচ্ছে। সিলেট ও সুন্দরবনের যে এলাকায় শকুন আছে সেই এলাকাকে সেফ জোন ঘোষণা করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওইসব এলাকায় যাতে ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন ব্যবহার না হয় সে বিষয়ে তদারকি করতে হবে।

এজন্য ড্রাগ হাউজ, পুলিশ, কমিউনিটি ভিত্তিক ওয়ার্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে শকুনের বাসা, ডিম, বাচ্চা রক্ষার জন্য সেফ জোনে কাজ করতে হবে বলে জানান তিনি।

সারওয়ার আলম আরও জানান, তাদের পক্ষ থেকে দেশে শকুনের একটি শুমারি পরিচালিত হচ্ছে। এতে দেখা যায় তিনশো শকুন তাদের গণনায় আনা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে দেশে এখন পাঁচশোর মতো শকুন রয়েছে।

তিনি বলেন, শকুন মারা যাওয়ার প্রধান কারণ ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ নিয়েও একটি জরিপ শুরু হয়েছে। জরিপের মধ্যে অর্ধেক গণনা শেষ। এতে দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ দোকানে কিটোপ্রোফেন, ১৮ শতাংশ নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক ও ১৭ শতাংশ মেলোক্সিক্যাম বিক্রি হচ্ছে।

শকুন রক্ষা প্রকল্পের আওতায় দেশে শকুন সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা প্রস্তুতের কাজ চলছে বলেও জানান এই প্রকল্প পরিচালক।

বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ও শকুন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য ইনাম আল হক বাংলানিউজকে জানান, ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হলেও কিটোপ্রোফেন এখন নিষিদ্ধ হয়নি। কিটোপ্রোফেন নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে গত দু’মাস আগে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটির পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

এক সময় গবাদি পশুর জন্য যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হতো এর মধ্যে শুধু ডাইক্লোফেনাকই ছিল ৬০ শতাংশ। নিষিদ্ধের পর এ ওষুধটি এখনও ১৬ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়:  ১২৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।