পুরো হেমন্ত ও শীতের আকাশ জুড়ে থাকে পরিযায়ী পাখির আগমনী ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সে শব্দ খোলা আকাশের নিচে নিস্তব্ধ রাতে অনুভব করা যায়।
বেশিরভাগ পরিয়ায়ী পাখি পরিভ্রমণের জন্য রাতকেই বেছে নেয়। রাতে সাধারণত প্যাঁচা, থ্রাস, চড়–ই , হাঁস, সোয়ান, সুইফট, সোয়লো, রেইল, ওয়েডার, কোকিল, ওয়ার্বলার, বান্টিং প্রজাতির পাখিরা বের হয়।
২০০৮ সালে হাকালুকি হাওরের খাল বিলে পরিযায়ী পাখি গুনতে গিয়ে কয়েক হাজার উত্তুরের ল্যাঞ্জা হাঁস (Northern Pintail) দেখতে পাই। একই বিলে ২০১১ সালে গিয়ে শ’তিনেক ল্যাঞ্জা হাঁস দেখি। উত্তরের ল্যাঞ্জা হাঁস শীতের সুলভ পরিযায়ী পাখি। বিশ্বের বিপন্ন পাখির তালিকায় এদের নাম এখনো ওঠেনি। দেশের সব বিভাগের নিরাপদ জলাশয়, প্রধানত হাওর ও নদীতে এদের দেখা যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ হাঁসের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে।
এর প্রধান কারণ শিকার ও জলাভূমির পরিমাণ হ্রাসকরণ। ঢাকার অভ্যন্তর ও উপকন্ঠের জলাভুমিগুলি এক সময় এ হাঁসের চারণক্ষেত্র ছিল। সেই সব নিম্নভূমি এখন ভূমিদস্যুদের দখলে! এখন শীতকালে আমাদের দেশের বড় নদী মোহনা, বড় হাওর, জলজ উদ্ভিদপূর্ণ বড় জলাশয় ও উপকূলীয় জলাভূমি এ পাখির প্রধান আবাস।
উত্তুরের ল্যাঞ্জা হাঁস বড় আকারের উজ্জ্বল ও বর্ণিল জলচর পাখি। সবসময় এ পাখি বড় ঝাঁকে থাকে। খুব দ্রুত উড়তে পারে। ভোরে, রাতে ও সন্ধ্যায় এ পাখি বেশি সক্রিয় থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখি দেখতে আলাদা। লেজের মাঝের পালক সরু ও লম্বা আলপিনের মতো, যা পুরুষ পাখিকে মেয়ে পাখি থেকে আলাদা করেছে। প্রজননকালীন সময়ে পুরুষ পাখির মাথা ও ঘাড় পিঙ্গল বর্ণের থাকে। ঘাড়ের দু’দিকে সাদা পট্টি সরু থেকে চওড়া হয়ে বুক ও পেটের কাছে মিশে যায়।
মেয়ে পাখির মাথা, লেজ ও ঘাড় অপেক্ষাকৃত ছোট। মাথা ও ঘাড়ের পালক বাদামি। বাকি দেহবর্ণ ধাতব বাদামি। উভয় পাখির চোখের মনি বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কালচে। দলে ও অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের ঝাঁকে এদের দেখা যায়। উত্তুরের ল্যাঞ্জা হাঁস প্রধানত নিরামিষভোজী। খাদ্য তালিকায় আছে জলজ আগাছা, কচি কাণ্ড,পাতা, বীজ, শস্য, কন্দ, শামুক ইত্যাদি। বাংলাদেশে এ পাখি বাসা করে না। প্রজনন সময় সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার উত্তারঞ্চেলের আর্দ্রভূমির লতা পাতার মধ্যে ঘাস, গাছ-গাছড়া ও পালক বিছিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৭-৯ টি। ডিমের রং ফ্যাকাসে সাগর নীল। ২১-২২ দিনে ডিম ফোটে, ৪০-৪৫ দিনে ছানার গায়ে ওড়ার পালক গজায়।
উত্তুরের ল্যাঞ্জা হাঁস বড় নদী, হ্রদ, মোহনা, উপকূলীয় লেগুন ও ঝিলে বিচরণ করে। সাধারণত ঝাঁকে চরে, মাঝেমাঝে অনেক বড় ঝাঁকেও দেখা যায়। এরা তীরে হেঁটে, অগভীর জলে সাঁতার কেটে অথবা পানিতে মাথা ডুবিয়ে আহার খোঁজে। ছেলে হাঁস ডাকে প্রিউ.., আর মেয়ে হাঁস ডাকে কিউয়্যাহ..। উত্তুরের ল্যাঞ্জা হাঁস আমাদের হাওড় বিশেষ করে হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওড়ে সর্বধিক দেখা যায়। শিকারিরা উত্তুরের ল্যাঞ্জা হাঁসই বেশি শিকার করে। আমাদের উচিত শীত মৌসুমে এ পাখি শিকার করার বিরুদ্ধে জনমত ও জনসচেতনামূলক কাজ করা।
বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৪