ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

একজন জয়নাল ও দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৪
একজন জয়নাল ও দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে: পৃথিবীর মোহমায়া ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছেন জয়নাল আবেদীন। কিন্তু রয়ে গেছে তার অনন্য কীর্তি।

সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওরজুড়ে তার সন্তানসম বৃক্ষগুলো এখন একদিকে যেমন প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়িয়েছে হাওরের সৌন্দর্য। আবার হাওরের মাটি সুরক্ষায়ও রাখছে বিরাট ভূমিকা।

দুর্গম হাওরের সবুজ বিপ্লবের এই নায়ক সম্পর্কে জানতে সম্প্রতি হাজির হয়েছিলাম সুনামগঞ্জের বাদাঘাট ইউনিয়নে। সেখানকার মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে অনেক ঘটনাবহুল বিষয়।

মাত্র ১২ বছর বয়সে জয়নাল আবেদীন তার পরিবারের সবার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জ জেলার বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যমী। সংগ্রামমুখর জীবনে অল্প বয়সেই ইতি টানেন পড়ালেখার। নানা পেশা বদলে একসময় জড়িয়ে পড়েন মৎস্য ব্যবসায়। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইনল্যান্ড ফিশারিজের মাধ্যমে ইজারা নেন টাঙ্গুয়ার হাওর। আবার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। কিন্তু শুধু ব্যবসা বাণিজ্যে মন ভরল না তার, ইচ্ছা আরো কিছু করার। যা মানুষের কল্যাণে আসবে। গাছপালার প্রতি ছিল তার অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তার এই পছন্দের সঙ্গে একাত্ম হলো তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের ভাবনা।

হাওরাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন কয়েকটি গুরুতর সমস্যায়। বর্ষা এলেই আমূল বদলে যায় এখানকার দৃশ্যপট। ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙতে থাকে পাড়। হাওরের আশপাশে যে ক’টি বাড়িঘর আছে সেগুলোও ঢেউয়ের তোড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এমন গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষরাই ঠিক করে নিলেন তাদের করণীয়। শক্ত শিকড় বাকড়ের জলসহিষ্ণু গাছপালাই এর একমাত্র সমাধান। সংখ্যায় কম হলেও এমন দু’একটি প্রজাতি সেখানে আগে থেকেই ছিল। যার অন্যতম হিজল এবং করচ।

গলা সমান পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কিছু দিন পর স্থানীয়দের এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন মাত্রা। এসব গাছের একাধিক উপযোগিতার মধ্যে তারা জ্বালানি সংগ্রহের গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারলেন। শুধু হিজল ও করচ লাগালেই একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান মিলবে। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুটা কিভাবে, আর করবেই বা কে?

স্থানীয় মানুষ যখন এসব নিয়ে ভাবছিলেন তখন অনেকটা পরিত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হলেন বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তিনি ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় ৯০ হাজার করচ গাছ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি হিজল গাছও লাগিয়েছিলেন বেশ কিছু। চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয়ভাবেই। শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হন নি তিনি। গাছের পুরো যতœ-আত্তির দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেন। শুকনো মৌসুমে নিজেই গাছে পানি দিতেন। একটানা ১৩ বছর তিনি সত্যিকার অর্থেই অসাধ্য সাধন করেছেন। টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে দু’পাশে চোখে রাখলে যে কারোই মনে প্রশ্ন জাগবে, এমন বিচ্ছিন্ন জনপদে কোথা থেকে এলো এত গাছ?

দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান
হাওরের ভেতর হিজল করচ লাগানোর পর জয়নাল আবেদীন ভাবলেন, আরো কিছু কাজ করা প্রয়োজন। গাছপালার পুরনো নেশাই আবার তাকে বাগান রচনায় প্ররোচিত করে। বাগানটির নাম শিমুল বাগান। তার এ ভাবনাটি যে একেবারেই আনকোরা সে কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। জানামতে, আমাদের দেশে বিস্তৃত পরিসরে এত বড় আর কোনো শিমুল বাগান নেই।

উত্তর বড়বদল ইউনিয়নের সুদৃশ্য জাদুকাটা নদীর তীর ঘেঁষেই মানিগাঁও গ্রাম। এ গ্রামে জয়নাল আবেদীনের ১০৭ কেয়ার (১ কেয়ার সমান ৩০ ডেসিমেল) জায়গা একেবারেই অনাবাদী ছিল। পলির পরিবর্তে এখানে উজান থেকে ভেসে আসে বালি। এই ধু-ধু বালিয়াড়িতে কিভাবে সবুজের প্রলেপ এঁকে দেওয়া যায়, এমন ভাবনা তাকে অনেকদিন ধরেই তাড়িত করে। একদিন শূন্য জায়গাটির পাশে দুটো পরিণত শিমুল গাছ দেখে তিনি ভাবেন, এখানে শিমুল বাগান করলে কেমন হয়! শেষমেষ তা-ই করেন তিনি। ২০০২ সালের দিকে শুরু করেন শিমুল বাগানের কাজ। প্রথমেই নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে সেখানে প্রাকৃতিক সার দিলেন। এভাবেই প্রস্তুত করে নিলেন মাটি। তারপর সেখানে লাগিয়ে দিলেন ৩ হাজার শিমুলের চারা। প্রায় ১২ বছরের ব্যবধানে বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে বাগানের গাছগুলো। কিছু কিছু গাছে ফুলও ফুটতে শুরু করেছে।

শিমুল বাগানের কাছেই আছে সুদৃশ্য বারেক টিলা। এই টিলায় বসে জাদুকাটা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় খুব সহজেই। আবার টিলার ওপর আছে কুরচি ফুলের বন। একসঙ্গে এত কুরচি গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য কুরচি গাছগুলো এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে।            

জয়নাল আবেদীন মূলত বাণিজ্যিক ভাবনা থেকেই শিমুল চাষ শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর পর তার ছেলে বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাখাব উদ্দিন এই বাগানের দেখাশোনা করেন। বাগানে তখন মিশ্র পদ্ধতিতে লেবুর চাষও করা হয়েছিল। এখন জয়নাল আবেদীন বেঁচে নেই, কিন্তু তার সন্তানসম বৃক্ষগুলো বেঁচে আছে। প্রতি বছর ফাগুনের অরুণ আলোয় ফোটে বাগানের শিমুল ফুলগুলো। এই টুকটুকে লাল ফুলগুলোই হয়তো তাকে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

বাংলাদেশ সময়: ০৪২০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।