ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

ঢাকার পাখি-৪

চোখ দেখে যায় না ভোলা যে পাখি

ইনাম আল হক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৪
চোখ দেখে যায় না ভোলা যে পাখি ধলাচোখ / ছবি : ইনাম আল হক

পাখিটির অসাধারণ দু’টি চোখ একবার দেখলে কেউ ভুলতে পারবেন না। তবুও এ পাখি অনেকেরই চোখে পড়েনি কোনোদিন।

ঢাকা নগরীর গাছে গাছে এ পাখির নিত্য আনাগোনা। কিন্তু ঢাকার অধিকাংশ নাগরিকের কাছে এই অনন্য নয়ন পাখিটি একেবারেই অচেনা।

আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, শজিনা, শিরিষ, বট কিংবা ঝাঁকড়া পাতার যে কোনো গাছে দলবেঁধে এরা উড়ে আসে। চঞ্চল, ব্যস্তবাগিশ পাখি। আকারে চড়ুইয়ের চেয়ে ছোট। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছুটোছুটি করে পোকামাকড় খোঁজে। সারাক্ষণ মৃদুকণ্ঠে সিফিফি, সিফিফি... বলতে থাকে। পোকা শিকারের কাজ শেষ হলে পাতার আড়ালে বসে একটু বিশ্রাম নেয়। মনে ধরলে একে অন্যের মাথা চুলকে দেয়। তারপর সদলবলে উড়ে চলে যায় অন্য গাছে।
 

অসাধারণ এই পাখিটির নাম ধলাচোখ। চোখের চারদিকে মোটা সাদা দাগ আছে বলেই এমন নাম। দেখে মনে হয় পাখিটি সাদা ফ্রেমের চশমা পরে আছে। এমন আজব চোখের আর কোনো পাখি এদেশে পাবেন না। এই চোখের জন্য একবার দেখলেই পাখিটিকে আপনি চিনতে পারবেন। তবে কচি-পাতার মতো সবজে-হলুদ পালকে মোড়া ছোট্ট এ পাখিটি পাতার ফাঁকে সহজেই চোখে পড়বে বলে মনে করবেন না। দূরবিন ছাড়া পাতার আড়াল থেকে এ পাখি খুঁজে বের করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ; নতুন পাখিদর্শকের জন্য তো বটেই। ভাগ্যবান হলে কোনো এক নির্জন দুপুরে ধানমন্ডি লেকের পানিতে হয়তো এদের মহা ফূর্তিতে ডানা নেড়ে পানি ছিটিয়ে স্নান করার দৃশ্য দেখতে পাবেন।

বর্ষায় ধলাচোখ বাসা বাঁধে। গাছের মগডালে মাকড়সার জাল দিয়ে সরু সরু কাঠি বেঁধে ছোট্ট বাটির মতো বাসা করে। এই বর্ষায় আপনার বাগান থেকে এ পাখিকে মাকড়সার জাল নিয়ে যেতে দেখলে বুঝবেন কাছেই কোনো গাছে সে সংসার পেতেছে। দল বেঁধে চলাফেরা করলেও বাসা বাঁধার সময় এরা আর দলে থাকে না। একটি গাছে কেবল এক জোড়া পাখিই বাসা বাঁধে। ছোট পাখির শত্রুর শেষ নেই। দল বেঁধে বাসা বাঁধলে কাক, কুবো ও হাঁড়িচাচার মতো পাখি এদের সব ডিম ও ছানা সাবাড় করে ফেলত। তাই এরা পাতার আড়ালে লুকিয়ে বাসা বাঁধে এবং অতি সন্তর্পণে সেখানে যাতায়াত করে।

পৃথিবীতে ধলাচোখের প্রজাতি-বৈচিত্র্য কম নয়। তোগিয়ান দ্বীপে সম্প্রতি আবিষ্কৃত ‘তোগিয়ান ধলাচোখ’ নিয়ে বিশ্বে এখন ৯৫ প্রজাতির ধলাচোখ রয়েছে। তবে এশিয়া ও আফ্রিকা ছাড়া আর কোনো মহাদেশে ধলাচোখের অস্তিত্ব নেই। আমাদের দেশে মাত্র একটি প্রজাতিই পাওয়া যায়। এর পোশাকি নাম ‘ওরিয়েন্টাল হোয়াইট-আই’, বাংলা নাম ‘উদয়ী ধলাচোখ’, বৈজ্ঞানিক নাম Zosterops palpebrosa।

এ পাখির হিন্দি নাম ‘বাবুন’, পশ্চিমবঙ্গের বাবুদের দেয়া নাম ‘বাবুনা’ অথবা ‘বাবুনাই’। ওই নামগুলো মনে রাখা কষ্টকর। পাখিটি দেখলেই  ধলাচোখ নামটি মনে আসে, কষ্ট করতে হয় না। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পুব দিকে চীন, ইন্দোচীন আর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত আমাদের উদয়ী ধলাচোখের বিস্তৃতি রয়েছে। শ্রীলংকায় অন্য একটি প্রজাতি পাওয়া যায়, নাম ‘সিলোন ধলাচোখ’। শ্রীলংকার মতো আরও অনেক দ্বীপেই আছে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ধলাচোখ, যেমন জাপানি, তিমোরি ও ফ্লোরেসি ধলাচোখ।

সিঙ্গাপুর ও ইন্দোচীনের নানা দেশে খাঁচার পাখি হিসেবে ধলাচোখ বেশ জনপ্রিয়। এমন মনমাতানো সবুজ-হলুদ রংয়ের পাখি; মোমের মতো মসৃণ পালক, এমন মৃদুভাষী, নির্ঝঞ্ঝাট জীব। তবে আমাদের দেশে খাঁচায় ধলাচোখ পোষার চেষ্টা না করাই ভালো। পোষা পাখি হিসেবে এদেশে খাঁচায় এখনও এর প্রজনন হয় না। পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে বলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এখানে এর আহার্য প্রস্তুত হয় না। রাজধানীতে বসেই জানালা দিয়ে আজও আমরা এ পাখির ঘর-কন্না দেখতে পাই। আমাদের বিনোদনের জন্য একে খাঁচাবন্দি করার তো কোনো প্রয়োজন নেই।


 ইনাম আল হক: বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ, প্রকৃতিপ্রেমী। বাংলাদেশের পাখি ও প্রকৃতি রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য প্রকৃতি ও  জীবন    ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই 'প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক-২০১৩' প্রাপ্ত।




** রাজধানীতে আজও আসে শামখোল

** বেঁচে থাকুক ঢাকার কোকিলেরা
** জীবনানন্দের লক্ষ্মী পাখির শেষ আশ্রয়


বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।