ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

অনুমোদন ২১০০, কাটা হলো ৪০০০ গাছ!

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৪
অনুমোদন ২১০০, কাটা হলো ৪০০০ গাছ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কমলগঞ্জ: হাজার হাজার কাটা গাছের বিশাল স্তূপ! পড়ে রয়েছে বাগানের প্রবেশমুখের একপাশে। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়।

কাটা ডালের শরীরের দিকে তাকালে সহজেই অনুমান করা যায় এগুলো সাম্প্রতিক সময়ের ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ। চা বাগানে অতিরিক্ত ছায়া অর্থাৎ, চা গাছে সূর্যালোক না পড়া ও বয়োবৃদ্ধ- এমন দুই কারণ দেখিয়ে ধ্বংস করা হলো মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি চা বাগানের চার সহস্রাধিক গাছ।

বাগানটি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন। এ বাগানের মোট আয়তন ৬১৬ দশমিক ৫৭ হেক্টর।

সরেজমিন ফুলবাড়ি চা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ উপজেলার প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশে লাউয়ছড়া জাতীয় উদ্যান ও পূর্ব পাশে এম. আহমদ টি কোম্পানির ফুলবাড়ি চা বাগান। কেটে ফেলে রাখা হয়েছে চাপালিশ, শিরিষ, সেগুন, কড়ইসহ মূল্যবান প্রজাতির গাছগুলো। এর মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক কাটাগাছও পাওয়া গেল। টিলার উপরে উঠে দেখা গেছে বড় বড় একেকটি মোথা (গাছের নিচের অংশ)। প্রচণ্ড তাপদাহে চা গাছগুলো ছায়াশূন্য হয়ে পড়েছে। কাটার পর বড় গাছ পড়ে ছোট ছোট চা গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চা বাগানের দু’জন গার্ড জানান, এই বিশাল বিশাল গাছগুলোর বড় বড় ডালপালা পড়ে নষ্ট হয়েছে অনেক চা গাছ।   এগুলো দেড়-দু’শ বছরের পুরনো। এইগুলো এতো বড় যে হাতি পর্যন্ত টানতে পারেনি। এখনো ৫৩৫টি গাছ কাটার বাকি রয়েছে।

তারা আরও জানান, এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রায় চার হাজার চার কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। শ্রীমঙ্গলের কদর আলী এবং কিবরিয়া মহালদার এ গাছগুলো কিনেছেন।

ফুলবাড়ি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক এস এম কামাল বলেন, আপনাদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। গাছ কাটার বিষয়টি পরিবেশের কোনো ক্ষতিই হবে না। বরং, এতে চা বাগানে অক্সিজেন প্রবাহ আরো বাড়ে। চা গাছে বেশি সূর্যের আলো পড়ে। চা বাগানের উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতিক্রমে পুরাতন গাছগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী লাউয়াছড়ার কোনো ক্ষতিই হবে না। সব ধরনের অনুমোদন নিয়ে এই কাজ করা হয়েছে।

মৌলভীবাজার উপ-বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. সাজ্জাদুজ্জামান বলেন, ফুলবাড়ি চা বাগানকে দুই হাজার ১৭৪টি গাছ অর্থাৎ, সাতাশ হাজার ৫১৫ দশমিক ৩২ ঘটফুট গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাগানের গাছগুলো কাটতে হলে বাংলাদেশ চা বোর্ড, জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি এবং বন বিভাগের অনুমোদন লাগে। সবগুলোই তাদের রয়েছে।

কত টাকা রাজস্বের বিনিময়ে এ অনুমোদন দেওয়া হলো সে উত্তর তিনি দিতে পারবেন না বলে জানান।

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম (এফইজেবি) মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি সৈয়দ মহসিন পারভেজ ও সাধারণ সম্পাদক নূরুল মোহাইমীন মিল্টন মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিন ফুলবাড়ি চা বাগানের কয়েকটি টিলা পরিদর্শন শেষে এক বলেন, বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে ফুলবাড়ি চা বাগানে যে হারে প্রাচীনতম গাছ নিধন হয়েছে, তাতে ওই এলাকায় পরিবেশ ও পশুপাখি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বন বিভাগ পরিবেশের কথা বিবেচনা না করেই একতরফাভাবে এতো গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে তা খুবই দুঃখজনক।

তারা আরও বলেন, ১৯৯৭ সনে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের প্রভাব, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বন্যপ্রাণি, পাখির আবাসস্থল ও খাবার ছাড়াও চা গাছের ছায়াবৃক্ষ হিসেবে ওই গাছগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু চাপালিশ, জাম, শিরিষসহ মূল্যবান প্রজাতির বৃহদাকার প্রায় ৪ হাজার গাছ বিলিন হওয়ায় লাউয়াছড়াসহ আশপাশের এলাকা আবারও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এ অবস্থা উত্তরণে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে তিনি জোর দাবি জানিয়েছেন।

প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘তরুপল্লব’ এর সাধারণ সম্পাদক ও প্রকৃতি বিষয়ক গবেষক, লেখক মোকারম হোসেন বলেন, এতোগুলো গাছ কাটার কোনো দরকার ছিল না। চা বাগানের ছায়া বেশি হলে সেক্ষেত্রে ওই গাছের ডালপালাগুলো ঘন করে কেটে দিলেই হতো। এটা না করে এভাবে শত শত গাছ কেটে ফেলা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হলো। কারণ ওই গাছগুলো আবার আগের পর্যায়ে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ততদিনে আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যতাও নষ্ট হবে। বনবিভাগের এভাবে অনুমোদন দেওয়া যুক্তিযুক্ত হয়নি।

মোকারম হোসেন আরও বলেন, গাছ কাটার ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায় থেকে যে নীতিমালা থাকা উচিত সেটা হলো, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন দেওয়ার আগে ওইসব এলাকার গাছগুলো ভালোভাবে পরিদর্শন করে যথাযথ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি যাচাইয়ের পর অনুমোদন দেওয়া উচিত।

একসময় এই গাছেরা জীবিত ছিল। সম্প্রতি তাদের হত্যা করা হলো। হত্যা করা হলো একেকটি বিশালাকৃতির অক্সিজেন ভান্ডারের এমন প্রাণপ্রাচুর্যকে। হত্যা করা হলো পাখিসহ নানা ধরনের জীববৈচিত্র্যের এরূপ আবাসস্থলকে। আর ওদিকে চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক যখন বলেন, ভাই আপনাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এই গাছকাটায় পরিবেশের কোনো ক্ষতিই হবে না। বরং চায়ের উপকারই হবে। ...’

এমন প্রকৃতিবিরোধী বক্তব্যই আমাদের দেশের বন ও পরিবেশ ধ্বংসে বহু ব্যবহৃত পুরাতন বিবৃতিগুলোর একটি, যা এতো এতো বছর ধরে কোটি কোটি গাছে করাত বসিয়ে আসছে! আর যা-ই হোক, পরিবেশধ্বংসকারী কোনো মানুষ এই পৃথিবীর‌ ‘মানুষ’ হতে পারেন না।  


বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।