ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

যদি ভুল করে চিনি

মাধবী, মালতী ও মধুমঞ্জরি

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫০ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৪
মাধবী, মালতী ও মধুমঞ্জরি

কয়েকটি ফুল নিয়ে আমাদের দেশে বিভ্রান্তি রয়েছে। এসব ফুল কেউ কেউ ভুল নামেও চেনেন।

আবার কেউ কেউ সঠিক নামটিও মানতে নারাজ। কিন্তু উদ্ভিদবিজ্ঞানের রীতি উপেক্ষা করে ভুল নামটিকে সঠিক ধরে নেওয়া বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে।

ভুল নামের ছড়াছড়ি মূলত নার্সারির চারা বিক্রেতাদের মাধ্যমে। তা সে যেভাবেই হোক, আসল কথা হলো নামগুলো শুধরে নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বহুল আলোচিত ভুলটি হচ্ছে মাধবী। তার সঙ্গে জড়ানো নামটি মধুমঞ্জরী বা মধুমালতী। আর আছে মালতী লতা। তিনটি গাছই লতানো হলেও ফুলের গড়ন, প্রস্ফুটনকাল ও অন্যান্য বৈশিষ্টগত ফারাক বিস্তর। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা তিনটি ফুলের পরিচিতই তুলে ধরবো। তাছাড়া রঞ্জক উদ্ভিদ দইগোটাকে জাফরান, হ্যাংগিং লবস্টার ক্লো বা হ্যালিকুনিয়াকে বার্ড অব প্যারাডাইস এবং ক্রেব বা ফুরুস ফুলকে চেরি হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়।

আদতে আমাদের দেশে চেরি কিংবা জাফরানের চাষ হয় না। ২০১২ সালে একজন পুষ্পপ্রেমিক তার ছাদবাগানে চেরি ফুল ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন। তবে দীর্ঘ মেয়াদে গাছটি বেঁচে থাকবে কিনা তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ অনেক যত্ন-আত্তি করে দু’একটা বার্ড অব প্যারাডাইসও ফোটাতে পারেন। তাও ততটা বাহারি হয় না। আশা করি মালতী, মাধবী ও মধুমঞ্জরী নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।   

মাধবী
ভুল করে মধুমালতী বা মধুমঞ্জরিকে মাধবী নামে ডাকা হয়। কিন্তু বাস্তব মাধবী (Hiptage benghalensis) নিতান্তই দুষ্প্রাপ্য। আছে গানে-আর বনে। জানামতে রমনা পার্ক, শিশু একাডেমির বাগান ও বলধা গার্ডেনে আছে। প্রস্ফুটন স্বল্পকালীন। ‘মাধবী হঠাৎ কোথা থেকে এলো ফাগুন-দিনের স্রোতে/ এসে হেসেই বলে ‘যাই যাই যাই’। কাষ্ঠলতা, ছড়ান, পত্রনিবিড়, শীতে পাতা ঝরায়। পাতা ভল্লাকার, ১০-১৬ সেমি. লম্বা, চার্ম, বিন্যাস বিপ্রতীপ। ফুল বসন্তের বার্তাবহ। প্রায় নিষ্পত্র ডাল ভরে থোকা থোকা সুগন্ধি সাদাটে প্রায় ৩ সেমি. লম্বা ফুল ফোটে। পাপড়ি সংখ্যা ৫, ৪টি সমান ও সাদা, ১টি ছোট ও হলুদ। ভারি সুগন্ধি, ভ্রমরাও উতলা হয়। সিলেটের বনে আপনিতেই জন্মায়। শুকনো ফলগুলো ভারি মজার-তিনটি পাখা মেলে দিব্যি হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। মাধবী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি:
   
১. মাধবিকা হোক সুরভি সোহাগে
        মধুপের মনোহরা।

২. বসন্তের জয়রবে
    দিগন্ত কাঁপিল যবে
          মাধবী করিল তার সজ্জা।

১.    মাধবী সহসা তার
     সঁপি দিল উপহার
     রূপ তার, মধু তার গন্ধ।

৪. সেদিন বনে মাধবী শাখা নিচু
             ফুলের ভারে ভারে।

৫. মৌমাছি যে পথ জানে
    মাধবীর অদৃশ্য আহ্বানে।

৬. বসন্তের মাধবী মঞ্জরী
    মিলনের স্বর্ণপাত্রে সুধা দিল ভরি।

৭. মাধবীকুঞ্জ বারবার করি বনলক্ষীর
                           ডালা দেয় ভরি।

৮. মাধবী বনের মধুগন্ধে মোদিত মোহিত
                               মন্থর বেলায়।

Ful_1
মালতী
মালতী কাষ্ঠলতাবিশেষ। রমনা পার্ক, শিশু একাডেমি, ছায়ানট ভবন প্রাঙ্গণ, সেগুনবাগিচা রিপোর্টাস ইউনিটি প্রাঙ্গণসহ অনেক স্থানেই চোখে পড়ে। এরা বহুবর্ষজীবী। বয়স্ক অবস্থায় বৃহদাকার। পাতা আয়তাকার, ৮ সেমি লম্বা, বোঁটা ও শিরা লালচে। ফুল সাদা, সুগন্ধি, গড়নের দিক থেকে অনেকটা শিউলি ফুলের মতো, পাপড়ি মোড়ানো। বৃতি ৫, লম্বা ও চোখা। দলনলের আগায় ৫ পাপড়ি, সরু ও লম্বা। প্রধান প্রস্ফুটনকাল বর্ষা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা কবিতা ও গানে মালতীকে বিখ্যাত করে তুলেছেন। বৈজ্ঞানিক নাম : Aganosma dichotoma. রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় অনেকবার মালতীর কথা বলেছেন:

১. কাননে ফুটে নবমালতী
         কদম্ব কেশর।

২. সেদিন মালতী যুথি জাতি
    কৌতূহলে উঠেছিল মাতি।
 
৩. শিউলি এলো ব্যস্ত হয়ে;
   এখনো বিদায় মিলিল না মালতীর।

৪. নিস্তব্ধ মালতী-ঝরা নিশা।

 ৫. ওই তো মালতী ঝরে পড়ে যায়
                       মোর আঙ্গিনায়।

৬. উতলা হয়েছে মালতীর লতা
          ফুরালো না তার মনে কথা।

৭. বনের প্রান্তে ওই মালতীলতা।

৮. মালতীর মালা অঞ্চলে ঢেকে কনক প্রদীপ
                  আনো আনো তব পথ পরে।

৯. না হয় রেখো মালতীকলি শিথিল কেশে।

১০. ফুল গন্ধ নিবেদন বেদন সুন্দর মালতী তব
                                     চরণে প্রণতা।

১১. মালতী বল্লরী কাঁপায় পল্লব করুণ
                                কল্লোলে।

১২. ওই মালতীলতা দোলে
          পিয়াল তরুর কোলে, পূব হাওয়াতে।

১৩. কুন্দ মালতী করিছে মিনতি হও প্রসন্ন।

১৪. শুধাতে হয় সে কথা কি
          ও মাধবী, ও মালতী।

১৫. মোর আঙিনাতে মালতী
            ঝরিয়া পড়ে যায়।

১৬. যে ফিরে মালতীবনে সুরভিত সমীরণে

১৭. বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে

ful_2
মধুমঞ্জরি
মালয়েশীয় প্রজাতি। কোথাও কোথাও মধুমালতী নামেও পরিচিত। এটি প্রায় সারাদেশেই সহজলভ্য। তাজা ও বাসিফুলে রঙের ভিন্নতাও এফুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদের ইংরেজি নাম রেঙ্গুনক্রিপার। মূলত এই ফুলটিই ভুল করে মাধবী নামে পরিচিত। কাষ্ঠলতার পত্রমোচী গাছ। পাতা একক, অখণ্ড, আয়তাকার ভল্লাকার, ৬ থেকে ৯ সেমি লম্বা, শিরা সামান্য রোমশ, বিন্যাস বিপ্রতীপ। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বেশি ফুল ফোটে। ডালের আগায় বড় বড় ঝুলন্ত থোকায় সুগন্ধি, সাদা ও লাল রঙের ফুল ফোটে সন্ধ্যায়। দলনল প্রায় ৫ সেমি লম্বা, মুখে ৫টি গোল লতি, ২সেমি চওড়া, সাদা, বাসি হলে লাল। সাদা ও ছোট ডবল ফুলের দুটি ভ্যারাইটি আছে। শেষেরটি ততটা লম্বা হয় না। গোড়ায় শিকড় থেকে চারা গজায়। সাধারণত কলমে চাষ। বৈজ্ঞানিক নাম : Quisqualis indica. এদের একটি প্রজাতির ফুল বড়, প্রায় ৭ সেমি লম্বা ও মুখ ৩ সেমি চওড়া। রবীন্দ্রাথ এফুলটির নামকরণ করেছেন মধুমঞ্জরি লতা। তিনি লিখেছেন:

 ‘নাম দিয়ে আমি নিলাম আপন করে
                              মধুমঞ্জরী লতা’।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।