ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

ঢাকার পাখি-৩

রাজধানীতে আজও আসে শামখোল

ইনাম আল হক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৮ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৪
রাজধানীতে আজও আসে শামখোল

ঢাকা: নগরীর গা ঘেঁষে যেসব নদী বয়ে গেছে তার পানি এখন সায়ানাইডের মতো শক্তিধর। যে কোনো জলচর পাখি ভুলক্রমে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা কিংবা বালুনদীতে নামলে তার প্রাণস্পন্দন সেখানেই শেষ।

নদীগুলো এখন যে একেবারেই পাখিশূন্য তাতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবুও ভয়ংকর এ নগরীতে এদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলচর পাখির আনাগোনা রয়েছে। এর নাম শামখোল।

সাভার কিংবা পুবাইলে প্রায়ই এর দেখা মেলে। নদীর চেয়ে খানা-খন্দ ও ডোবা-নালাই এ পাখির বেশি পছন্দ। তাই হয়তো এরা এখনও সায়ানাইড-নদীর মরণ-ফাঁদে ধরা পড়েনি। শামখোল বেশ লম্বা ও বড়সড় পাখি। পানিতে হেঁটে বেড়াবার জন্য লম্বা পা আছে বলে মাটি থেকে তার উচ্চতা প্রায় আড়াই ফুট। ছড়ানো দুই ডানার মাপ তিন ফুটের কম হবে না।

এককালে বাংলাদেশের সর্বত্র শামখোল দেখা যেত। শুধু শামুক-ঝিনুক খেয়েই বেঁচে থাকতে পারে বলে পাখিটির সাথে মানুষের কোনো বিবাদ নেই। যে কোনো বাদা, বিল, হাওর-বাওড়ে নেমে কয়েকটা শামুক ধরতে পারলেই শামখোলের ভোজন-পর্ব সম্পন্ন হয়। শামুকের প্রতি এই অসাধারণ আসক্তির কারণেই বাংলার মানুষ এর নাম দিয়েছে শামুকভাঙা, শামুকখোর, শামুকখোল কিংবা শামখোল।



দুই চঞ্চুর মধ্যে একটা বড় ফাঁক থাকায় শামখোল অদ্ভুত-দর্শন এক পাখি। মুখটা পুরোপুরি বন্ধ করার পরও এর ঠোঁটের ফাঁক কখনো বন্ধ হয় না। এ জন্যই শামখোলের ইংরেজি নাম ওপেন-বিল, অর্থাৎ খোলা-ঠোঁট। শামখোলের বৈজ্ঞানিক নামটা আরো মজার- অ্যানাস্টোমাস অসিট্যান্স (Anastomus oscitans) - যার মানে ’হাই-তোলা মুখ’। আমাদের শামখোলের পুরো নাম ‘এশীয় শামখোল’। এছাড়া পৃথিবীতে আর এক প্রজাতির খোলা-ঠোঁট পাখি আছে যার নাম ‘আফ্রিকার শামখোল’।

শামুক-ভাঙার কাজে দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই শামখোলের ঠোঁটের এই অদ্ভুত গড়ন হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে আজ পর্যন্ত কোনো বিশেষজ্ঞ তা হলফ করে বলতে পারেনি। বিখ্যাত পাখিবিদ জার্ডন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা শামখোলকে একবার খাঁচায় রেখে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু, শামখোলটি এমন চোখের পলকে শামুকগুলো ভেঙে ফেলতো যে ওই কাজে ঠোঁটের ফাঁকের ভূমিকা কি ছিল সে ব্যাপারে জার্ডন অনিশ্চিতই থেকে যান। শামখোলের চোখে ঠুলি পরিয়ে জার্ডন দেখেছিলেন পাখিটি চোখে না দেখলেও সমান দক্ষতার সাথে শামুকগুলো ভাঙতে পারে। মজার ব্যাপার, শামখোল ছানার ঠোঁটে কোনো ফাঁক থাকে না। বাসা ছেড়ে জলায় নেমে নিজেরা শামুক ভেঙে খেতে শুরু করার পর বাড়ন্ত ছানাদের ঠোঁট ধীরে ধীরে ফাঁক হতে থাকে।

খোলা-ঠোঁটের রহস্যের মতোই শামখোলের কিছু কিছু আচরণেরও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। একবার আংটি-পরানো এক শামখোল-ছানাকে থাইল্যান্ডে তার বাসা ছেড়ে বিদায় হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ১৫০০ কিমি দূরে বাংলাদেশে পাওয়া গেল। শামখোল সাধারণত দূর-পাল্লার পরিব্রাজক নয়। তাই, ওই ছানাটির বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য আজও ব্যাখ্যা করা যায়নি। এছাড়া, মাঝরাতে উপকূলের বাতিঘরে আছড়ে পড়ে যেসব শামখোল আত্মাহুতি দেয় তাদের আচরণও ব্যাখ্যা করা যায় না। শামখোল সাগরের পাখি নয়, নিশাচরও নয়। বাতি লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে কেন সে সাগরের দিকে উড়াল দেয় তা কারও জানা নেই।



পৃথিবীতে এখন মাত্র এক লাখ শামখোল টিকে আছে। ভারতবর্ষ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দু’একটি দেশই এদের শেষ আশ্রয়। তবে বাংলাদেশে এ পাখির দেখা পাওয়া কঠিন নয়। রাজশাহী শহর সংলগ্ন পদ্মার চরে প্রতি বছর শামখোলের ঝাঁক দেখা যায়। শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর আর কুলাউড়ার হাকালুকি হাওরে শামখোলের কলোনি রয়েছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় শামখোলের ঝাঁক দেখা যায়। ভোলার দক্ষিণের উপকূলে আমরা মাঝে মাঝে শামখোলের ঝাঁক দেখতে পাই। তবে সব মিলে বাংলাদেশে শামখোলের সংখ্যা দু-তিন হাজারের বেশি হবে না। খুবই ছোট একটি জনসংখ্যা। ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্যে পর্যাপ্ত নয়। তার উপরে আমরা বিল-বাওড় থেকে যে হারে শামুক-ঝিনুক আহরণ করে ফিড-মিল পরিচালকদের কাছে বিক্রি করছি তাতে করে শামখোলের জনসংখ্যা ভবিষ্যতে কমবে বই বাড়বে না।

 

 

ইনাম আল হক: বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ, প্রকৃতিপ্রেমী। বাংলাদেশের পাখি ও প্রকৃতি রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য প্রকৃতি ও  জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই 'প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক-২০১৩' প্রাপ্ত।



** বেঁচে থাকুক ঢাকার কোকিলেরা

** জীবনানন্দের লক্ষ্মী পাখির শেষ আশ্রয়


বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।