ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

পরিবেশ সংরক্ষণে কাণ্ডারি হোক তারুণ্য

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৮ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪
পরিবেশ সংরক্ষণে কাণ্ডারি হোক তারুণ্য ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: রবীন্দ্রনাথ বনবাণী কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমার ঘরের আশেপাশে যে-সব আমার বোবা-বন্ধু আলোর প্রেমে মত্ত হয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে তাদের ডাক আমার মনের মধ্যে পৌঁছল। তাদের ভাষা হচ্ছে জীবজগতের আদিভাষা, তার ইশারা গিয়ে পোঁছয় প্রাণের প্রথমতম স্তরে; হাজার হাজার বৎসরের ভুলে-যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়; মনের মধ্যে যে-সাড়া ওঠে সেও ঐ গাছের ভাষায়- তার কোনো স্পষ্ট মানে নেই, অথচ তার মধ্যে বহু যুগযুগান্তর গুনগুনিয়ে ওঠে।



কবি সত্যিকার অর্থেই মনের চোখে দেখেছেন বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য। আর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ওদের পারস্পরিক ভাববিনিময়ের ভাষা। জীবজগৎ সম্পর্কে একজন কবির এই যে ভাবনা ও বোধের গভীরতা আমরা সেখান থেকে ছিটকে পড়েছি অনেক দূরে। বরং জীবজগতের ধ্বংসই যেন এখন অনিবার্য পরিণতি।

কিন্তু এখনো আমাদের সব সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় নি। প্রকৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবেশ ব্যবস্থার উন্নয়নে খোলা আছে অনেক পথ। কিন্তু শুরুটা করতে হবে এখনই। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। কারণ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সারাবিশ্বের অধিকাংশ দেশ আক্রান্ত। দুঃসংবাদ হলো, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকলেও পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক ফলাফল পুরোপুরিই ভোগ করতে হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব নেত‍ারা এনিয়ে দফায় দফায় আলোচনায় বসেছেন, সমাধানের উপায় খুঁজেছেন, কিন্তু সন্তোষজনক ফলাফল আসে নি।

সব কিছুর আগে আমাদের প্রয়োজন একটি সচেতন জনগোষ্ঠী। যত দিন না আমরা বুঝতে পারবো প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকবো, ততদিন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতেই হবে। বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। তাই ভবিষ্যতে আমরা কীভাবে ভালো থাকবো আগে সে বিষয়টি উপলদ্ধি করতে হবে। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলার মাধ্যমে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে পারে। শুধু একটি প্রশ্ন সবার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, কেন প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে? এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আমাদের অনেক সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে।

একটি বিশাল সচেতন জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে গিয়ে কোনো সরকার বা সংস্থা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ পায় না। অর্থাৎ, একজন সাধারণ মানুষ যদি বুঝতে পারেন নদী দখল করে বা বন উজাড় করে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করলে ক্ষতিটা নিজেদেরই তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই কম।

এখনো আমাদের যা কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তার সঠিক সংরক্ষণের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে পারে প্রতিবেশ ব্যবস্থা। কোনো অবস্থাতেই বন-পাহাড়ের আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। বাণিজ্যিক চাষাবাদের নামে বন-পাহাড়ের ইকোসিস্টেম ধ্বংস করা যাবে না। বন-পাহাড়ের তৃণ-গুল্ম সাফ করে সেখানে বিদেশি বৃক্ষের চাষবাস অযৌক্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
বনের নিজস্বতা নষ্ট করে মানুষ যদি বনকে শাসন করতে চায় তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

উদ্ভিদ ও জীবজগৎ পরস্পর নির্ভরশীল। একটির অনুপস্থিতি অন্যটির টিকে থাকা অনিশ্চিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবন এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এমতাবস্থায় সুন্দরবনকে কোনা অবস্থাতেই ‘বিরক্ত’ করা উচিত নয়। কিন্তু সরকারে বন বিভাগসহ চোরা শিকারিরা প্রতিনিয়ত তাই করছেন। এসব কারণে ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বনের পরিধি। বন সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। সুন্দরবনকে বাঁচাতে না পারলে আমরাও বাঁচতে পারবো না।  
সারাদেশে সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল, অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যানগুলো শুধু নামেই আছে। আদতে খুবই বেহালদশা। এসব বনাঞ্চলে যে হারে জীবজন্তু হত্যা এবং বনজ সম্পদ উজাড় করা হচ্ছে তাতে নিশ্চিহ্ন হতে বেশি সময় বাকি নেই।

এখনই থামাতে হবে এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। যারা এসব অপকর্মে জড়িত তারা নিঃসন্দেহে দেশের শত্রু। এমন শত্রুদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা দরকার। এধরনের স্থাপনায় আর কোনো বৃক্ষনিধন বা প্রাণী হত্যা করা যাবে না। তাহলে হয়তো বনভূমিগুলো আবার ফিরে পেতে পারে প্রাচীন আরণ্যক নিবিড়তা।

সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়গুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অন্যতম উৎস। বিল হাওর এবং নদীগুলো নানাভাবে দেশের প্রাণবৈচিত্র্যের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে নদী ও বিল হাওরগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। নদী দূষণ ও নাব্যতা হ্রাস পাওয়া যতটা না প্রাকৃতিক ততটাই মানুষসৃষ্ট। আমরা নদী দখল করে, বিল-ঝিল সেচে, বসতিগেড়ে বিলুপ্তির প্রক্রিয়া আরো তরান্বিত করেছি। নদী ও জলাশয়গুলো ভালো না থাকলে সমগ্র জীবজগতই হুমকির মুখে পড়ে।

আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সোনালি ভবিষ্যতের। এই স্বপ্নের কাণ্ডারি আমাদের তরুণসমাজ। তরুণরাই এভারেস্টের চূড়ায় লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েছে। ওরাই এখন পাখি দেখতে বেরোয়, দেখে ফুল-প্রজাপতি। কোথাও বৃক্ষ নিধন হলে, বন উজাড় হলে, নদী আক্রান্ত হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ওদের চোখে এখন প্রতিবাদের মশাল। তারুণ্যের এই ক্ষুদ্র মিছিলটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ মিছিলে পরিণত করতে হবে। সমাজের আলোকিত মানুষদের প্রধান কাজ ওদের সঠিক পথটি দেখিয়ে দেওয়া।

ভালোভাবে বেঁচে থাকার পথ একটাই, দেশকে ভালোবাসা। তাহলেই কবির কল্পনার মতো একটি সমৃদ্ধ-সবুজ দেশ আমরা পাব।

নরম ধানের গন্ধÑকলমীর ঘ্রাণ,/ হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা-সরপুঁটিদের/ মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাতÑশীত হাতখানা,/ কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাসÑলাল লাল বটের ফলের/ ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতাÑএরই মাঝে বাংলার প্রাণ:। (জীবনানন্দ দাশ) 

বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।