ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

নতুন চর, হারানো ভিটের খোঁজ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪১ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০১৪
নতুন চর, হারানো ভিটের খোঁজ! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রহমতপুর, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম ঘুরে এসে: নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে নতুন চরের সীমারেখা টানার চেষ্টা করছিলেন পঁচাত্তর বছর বয়সী সোলায়মান। এই নদীতেই ডুবেছে তার বাড়ি, টিনের ঘর, গাছপালা, পুকুর, চাষের জমি, সবইকিছু।

নদীর তাড়া খেয়ে পেছনে ছুটেছেন। সেই নদীতে নতুন চর দেখে আশায় বুক বাধছেন। আবার মনে পড়ছে সেই পুরানো দিনের গল্প।

এটা দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের পশ্চিমে মেঘনা তীরের রহমতপুর, হরিশপুর এলাকার গল্প। ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত এই এলাকার ভাঙন থেমে এখন নতুন চরের দেখা মিলেছে। ভাটার সময় পলি মাটির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় অনেক দূরে। স্থানীয়দের দেয়া ধারণা মতে, এই চরের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আর এই চর ঘিরে সোলায়মানের মত এই এলাকার বহু মানুষ জীবনের নতুন স্বপ্ন বুনছেন।      

ছোটবেলা থেকে নদী-ভাঙনের ভয়াবহ রূপ দেখে আসা সোলায়মান বাংলানিউজকে জানাচ্ছিলেন তার জীবনের নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার গল্প। সব হারিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই চলে গেছে অন্যত্র। তিনি কোনো মতে অন্যের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ এক সময় তার সব ছিল।



কথা বলার সময় গোলাম মোস্তফা, আবুল কালাম, খাদিজা বেগমসহ আরও অনেকে ভিড় করেন। জানান তাদের সব হারানোর কাহিনি। তবে এরা সকলেই নতুন চরের জমি পাওয়ার আশা করছেন। এ কারণে অনেকে আবার জমির খাজনাপাতি শোধ করতে তহসিল অফিসে ছুটছেন। নিজের কিংবা বাপ-দাদার নামের জমিটুকুর কাগজপত্র ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করছেন, যাতে জেগে ওঠার জমির খতিয়ানে তার নামটি থাকে।      

প্রতিনিয়ত নদী-ভাঙনে ছোট হয়ে যাওয়া রহমতপুর ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে হঠাৎ করেই এই চরটি দেখা গেছে। এর জন্য এলাকার মানুষকে অন্তত শত শত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। পাশে প্রায় এক কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার আকৃতির এই চর দেখে সন্দ্বীপের বহু নিঃস্ব মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।



চরের নিকটবর্তী গ্রামের লোকজন জানালেন, ভাটার সময় এই চর দেখা যায়। লোকজন অনেক দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে পারে। প্রথমদিকে চরের মাটি নরম ছিল, দিনে দিনে এ মাটি শক্ত হচ্ছে। অল্পদিনের মধ্যে চর জেগে উঠবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।

শুধু সন্দ্বীপের পশ্চিমে নয়, পূর্বে গুপ্তছড়া, উত্তরে কালাপানিয়া এলাকার আশপাশেও বেশ কয়েকটি চর রয়েছে। কিছু চরে বনায়ন করেছে স্থানীয় বন বিভাগ। তবে নতুন চরের কোথাও ভাঙন দেখা দেওয়ায় নতুন সৃজিত বন ক্ষতির মুখে পড়ছে।



গুপ্তছড়া ঘাটের দু’পাশ জুড়ে বিশাল চর জেগে উঠেছে বেশ কয়েক বছর আগে। চরের ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে দীর্ঘ জেটি। এই জেটি দিয়ে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে আসা সী-ট্রাক, স্পিডবোট, ট্রলার এসে ভেড়ে। এই চর রক্ষা করতে বন বিভাগ লাগিয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। স্থানীয় লোকজন মনে করেন, এই নতুন চর ক্ষয়ে যাওয়া সন্দ্বীপকে সমৃদ্ধ হতে সহায়তা করবে।

আবুল কালামের বাড়ি ছিল রুনি ইউনিয়নে, এরপর এলো হরিশপুরের ডহরি গ্রামে, এরপর তুলাতলী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে। নদীর তারা খেয়ে এভাবে তার জীবনের গতি বদলেছে। ঘরবাড়ি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে তার পেশা। এক সময় নিজের জমিতেই কৃষি কাজ করতেন, আর এখন ট্রলারে চাকরি করেন। থাকে সরকারি খাস জমিতে। সব হারিয়ে নিঃস্ব আবুল কালাম নতুন চরে ভিটে পাওয়ার প্রত্যাশা করেন।

নতুন চর নিয়ে এলাকা মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখছে, বকেয়া খাজনাপাতি শোধ করে জমির কাগজপত্র ঠিক করছে; কিন্তু তারপরেও বহু প্রশ্ন তাদের মনে। এই জমি কি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পাবে, নাকি চলে যাবে প্রভাশালীদের দখলে? চর দখলের কোন ষড়যন্ত্র হবে না তো? ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার আশা নিয়ে দিন গুনছেন।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৪ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।