ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

এখনো আইলার ক্ষত উপকূলবাসীর মনে

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২২ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৪
এখনো আইলার ক্ষত উপকূলবাসীর মনে

খুলনা: পাঁচ বছর পরেও উপকূলের দুর্গত লোকজনের জীবনে আইলার ক্ষত এখনো জলজ্যান্ত। ২০০৯ সালের ২৫ মে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদ।

বিরানভূমিতে পরিণত হয় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে প্রায় দুইশ মানুষের প্রাণহানিসহ মারা যায় হাজার হাজার গবাদি পশু ও জীবজন্তু। ধ্বংস হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

আইলায় আঘাত হানার এতদিন পরও উপকূলীয় জনপদ এখনও ধ্বংসের ঘোর কাটিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। এখনও হতদরিদ্র অনেক মানুষ আশ্রয়হীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। লাখ লাখ মানুষের জীবন এখনো স্বাভাবিক নয়, খাদ্য-পানি-আশ্রয় ও চিকিৎসার অভাবে মানুষ এখনো ধুঁকছে।
 
সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, আইলায় প্রায় ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে প্রাণ হারান ১৯৩ জন মানুষ। ২ লাখ ৪৩ হাজার ঘরবাড়ি পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় এবং ৯৭ হাজার একর জমির আমন ফসল পুরোপুরি বিনষ্ট হয়। কাজ হারায় প্রায় ৭৩ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক।

প্রাথমিকভাবে আইলার ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব হয় ভয়ঙ্কর। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে খুলনার দাকোপ ও কয়রা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ১২টি ইউনিয়নের ২২৫টি গ্রাম পুরোপুরি নোনাপানিতে তলিয়ে যায়। নোনা পানির প্রভাবে ৫০০ গরু, দেড় হাজার ছাগল মারা যায়। ঘরবাড়ি ও পেশা হারিয়ে উপদ্রুত এলাকা থেকে বাস্তুহারা হয়ে পড়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ।

এক জরিপে দেখা যায়, আইলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়ন, কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়ন এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন।

এখনো আকাশে মেঘ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর কপোতাক্ষ ও শাকবাড়ীয়া নদীর পানি একটু বাড়লেই আতকে ওঠেন উপকূলীয় কয়রার মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইলার আঘাতের পাঁচ বছরেও বিধ্বস্থ খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলায় নির্মিত হয়নি কোনো নতুন সাইক্লোন শেল্টার। মেরামত হয়নি জরাজীর্ণ সাইক্লোন শেল্টারগুলো। বিস্তীর্ণ উপকূলের কিছু স্থানে ২/১টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। আসন্ন বর্ষা মৌসুম আতংকিত করে তুলছে আইলা বিধ্বস্থ খুলনার চার উপজেলার ৫০ লক্ষাধিক মানুষকে।

পাঁচ বছর পার হলেও খুলনার দাকোপ, কয়রা, বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা উপজেলার ২৫টি গ্রামের আড়াই সহস্রাধিক পরিবার এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। ভিটেমাটি হারিয়ে অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে ওয়াপদার বেড়িবাঁধে। সরকারের পূর্নবাসন সহায়তা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। এ মানুষগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছেন। খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটছে ঝুঁপড়ি ঘরে।

দাকোপের কালাবগী গ্রামের মো. আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, বিশ বছরের আয় রোজগারের অর্থ দিয়ে একটি বাড়ির মালিক হয়েছিলাম। আইলার তান্ডবলীলার দুই দিন পর পাওয়া যায় শুধু বাড়ির নিশানাটুকু। ঘরের পোতার চি‎হ্ন ছাড়া সম্বল বলতে কিছু ছিল না। আইলার পাঁচ বছর পর এখনো সেই মাটির পোতা আঁকড়ে পড়ে আছি। এরপর আর ঘর তোলা সম্ভব হয়নি।

আব্দুল্লাহর মতো অবস্থা গ্রামের অনেকেরই। এদের কেউ কেউ এখন বেড়িবাঁধের উপর ঝুপড়ি ঘর তুলে থাকছেন।
 
স্থানীয় কবির হোসেন ও আবু মুসা অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী মহল পাউবোর সংস্কারকৃত আইলা বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলোতে পাইপ ও কালভার্ট দিয়ে নদীর লবণ পানি তুলে চিংড়ি চাষ করায় তারা সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আইলা দুর্গত মঞ্চের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বাংলানিউজকে জানান, দাকোপ ও কয়রা উপজেলার নতুন করে আড়াই হাজার একর জমিতে লবণ পানি তুলে চিংড়ি ঘের করা হচ্ছে। বেড়িবাঁধগুলোর তলা দিয়ে কয়েকশ’ পাইপ ও কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে নদীর লবণ পানি তোলার ফলে বেড়িবাঁধের মাটির গঠন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং মাটি উড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বেড়িবাঁধগুলো ভেঙ্গে পানিতে তলিয়ে যাবে গ্রামের পর গ্রাম।

তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা প্রভাব খাটিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে এ লবণ পানি তুলছে।

ছিন্নমূল মানুষগুলোকে দ্রুত পূনর্বাসন করা না গেলে দুর্গত এলাকায় মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা করছেন দাকোপ উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেন।

তিনি আইলা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সাইক্লোন শেল্টারের সংকটের কথা স্বীকার করে দ্রুত প্রয়োজনীয় শেল্টার নির্মানের দাবি জানান।

এদিকে এ দিনটির স্মরণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল, গণকবরে শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা সভা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৬ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।