ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের ঠাঁই কোথায়!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৮ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৪
জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের ঠাঁই কোথায়! ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার : সমুদ্রপাড়ে ছোট্ট থাকার ঝুপড়ি। জোয়ারের পানি লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু।

বর্ষায় থাকার ঝুপড়িটা ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্যত্র। কখনো জোয়ারের পানি সরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়। এরপর আবার খাবার যোগাড়ের চিন্তা। রোজগার না হলে তো রান্নার হাঁড়ি উঠবে না চুলায়।

কুতুবদিয়াপাড়ার মানুষদের এ এক ভিন্ন জীবন। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। একবার ঘূর্ণিঝড়ে সব হারায়, আরেকবার নদী-ভাঙন নি:স্ব করে, আবার জলোচ্ছ্বাস এদেরকে অসহায় করে তোলে। তবুও বাঁচতে হয় এই নদী কিনার ঘেঁষে। কারণ এখানেই জীবিকা। রোজগারের তাগিদে ছুটতে হয় সমুদ্রে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানান দুর্যোগে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটে চলা মানুষেরা জলবায়ু উদ্বাস্তু। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগ বাড়ছে। আর সেইসব দুর্যোগে নি:স্ব হচ্ছে বহু মানুষ। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধে, সরকারি খাসজমিতে, অবস্থাপন্নদের জমিতে, লঞ্চঘাটে, পরিত্যক্ত বাড়িঘরে এমন হাজারো মানুষের দেখা মেলে। জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের পুনর্বাসনে অর্থ আছে, ব্যয়ও হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা এর সুবিধা পাচ্ছে না। কুতুবদিয়াপাড়া ঘুরে তারই প্রমাণ মেলে।    

কক্সবাজার শহর থেকে খানিক দূরে পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডে একখণ্ড কুতুবদিয়া, নাম কুতুবদিয়াপাড়া। কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার নি:স্ব অসহায় মানুষেরা সমুদ্র মোহনার নির্জন এলাকায় ঘর বেঁধেছিল ১৯৮৭ সালে। প্রথমদফায় ভাঙন কবলিত ১৬৫ পরিবার, পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত আরও বহু পরিবার এখানে ঠাঁই নেয়। পর্যায়ক্রমে কুতুবদিয়াপাড়াটির নাম ওঠে কাগজপত্রে। পাড়ার মানুষদের নাম ওঠে ভোটার তালিকায়। কিন্তু এরা আজও সব নাগরিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত।  

স্থানীয় সূত্র বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে নি:স্ব মানুষদের ঠিকানা এই কুতুবদিয়া পাড়ার বয়স প্রায় ৩০ বছর হতে চললেও এখানকার বাসিন্দারা স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকারটুকু পায়নি। সরকারি এই খাসজমি থেকে এদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। একদিকে দুর্যোগের ভয়, অন্যদিকে রোজগারের চিন্তা, তার ওপর উচ্ছেদের আতংক রয়েছে এখানকার মানুষদের মনে।

কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা আকতার কামাল আজাদ পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনিও কুতুবদিয়া থেকে আসা নি:স্ব মানুষদের দলে। পাড়ায় সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে বাংলানিউজের সঙ্গে দেখা মেলে এই কমিশনারের। তিনি জানাচ্ছিলেন, পাড়ার সব মানুষের মত তারও নিজের কোন জমি নেই। ভাসমান অবস্থায় বসবাস করছেন পাড়ার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। চার হাজারের বেশি পরিবার এরপর কোন দুর্যোগের মুখে পড়লে কোথায় যাবেন, তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

কমিশনার জানান, পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের সবাই ভূমিহীন। কারও নামে একখণ্ড জমি নেই। এই খাসজমি কক্সবাজার বিমানবন্দরের নামে নেয়া হয়েছে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, বিমানবন্দরের নামে বরাদ্দকৃত জমি থেকে কিছু জমি কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দাদের দেয়া হবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির কোন অগ্রগতি এখানকার বাসিন্দারা দেখতে পারছেন না।     
 
কুতুবদিয়াপাড়ার ভাসমান মানুষদের সংকটের শেষ নেই। ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে বসবাস। পাড়ার কিছু লোক হয়তো শুটকি মাছের ব্যবসা করে কিছু অর্থ-কড়ি জমিয়েছেন, কিছু পাকা ভবনও উঠেছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের তিনবেলা খাবার যোগাড়ে অনেক কষ্ট করতে হয়। জীবিকার তাগিদে বহু ছেলেমেয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে নেমেছে।

কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা মো. আরিফ, বয়স মাত্র ১৩ বছর। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরেনি বাবা জাহাঙ্গীর আলম। মা আর দুই ভাইয়ের সংসারের হাল ধরতে হয়েছে আরিফকে। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এখন চাচা ফরিদুল আলমের সঙ্গে পাড়ার ভেতরে একটি ছোট্ট দোকান চালাচ্ছে। এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো, যারা জীবিকার তাগিদেই লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর পরিবারকে আর্থিক অনটনের মুখে ফেলেছে এই দুর্যোগ।

কুতুবদিয়াপাড়ার শেষ সীমানায় সমুদ্রের মোহনায় থাকার ঘরের সঙ্গেই পাখি বেগমের ছোট্ট দোকান। ভাঙনে নি:স্ব হয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখানে এসেছেন। এই বাড়িটা এখন ভাঙনের মুখে। প্রতিদিনের জোয়ারে ভাসে। বর্ষায় সংকট আরও বাড়ে। এখানে যখন এসেছিলেন, তখন স্বামী আবুল কাশেম সঙ্গে ছিল। পরে তিনটি মেয়ে রেখে সে চলে যায়। তিন মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন পাখি। এখান থেকে চলে যেতে হলে কী করবেন, ভেবে পান না পাখি।

সমুদ্রের মোহনায় বিরাট এলাকা নিয়ে জেগে থাকা কুতুবদিয়াপাড়ায় ছোট ছোট ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেছে সরু গলিপথ। একটা গলি ভাঙনের মুখে পড়ে, আরেকটা তৈরি হয়। ভেতর দিয়ে একটি ইট বিছানো রাস্তা নির্মাণ ছাড়া বিশেষ কোন উন্নয়নের ছোঁয়া এখানে পড়েনি। যে মানুষগুলো এখানকার বালুটিলায় এসে ঘর বেঁধেছিল, তারাই এখানে নারিকেলসহ বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে নিজেদের ভিত শক্ত করার চেষ্টা করেছে।

অন্যদিকে কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দারা নিজেদের জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ার পাশে গড়ে তুলেছে দেশের সর্ববৃহৎ শুটকি পল্লী। যেখান থেকে মৌসুমে কোটি কোটি টাকার শুটকি বেচাকেনা হয়। এ থেকে সরকারও আয় করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তারপরও এই মানুষগুলো অবহেলার মাঝেই বেঁচে আছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের বিপন্ন মানুষদের তাড়িয়ে ফেরে বার বার। এক দুর্যোগ থেকে তারা আরেক দুর্যোগের মুখে পড়ে। নদী-ভাঙনে নি:স্ব মানুষের জীবন লণ্ড-ভণ্ড করে দেয় জলোচ্ছ্বাস। তবুও এরা সমুদ্রতীর ঘেঁষেই থাকতে চায়, কারণ এখানেই তাদের জীবিকা।   আবার জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এসে ঘর বাঁধে। নতুন বসতিতে জলোচ্ছ্বাসে ঘর ডুবে যায়। বর্ষা এলে তাদের আতংক আরও বেড়ে যায়। তাহলে জলবায়ু উদ্বাস্তু এই মানুষগুলোর ঠাঁই কোথায়!

বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৫ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।