ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

ব্যাঙ কথন

অনিমেষ ঘোষ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৪
ব্যাঙ কথন

ব্যাঙ- নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চার পা বিশিষ্ট ছোট্ট একটি প্রাণী। প্রাণীটি এতোই ছোট যে অনেকেই প্রাণীটির ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন আছে বলে মনেই করেন না! অথচ এই ছোট্ট প্রাণী যে কতোভাবে আমাদের উপকার করে যাচ্ছে তা আমরা কয় জনই বা জানি!

তার ওপর আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের কথিত উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে ধ্বংস করে চলেছি এদের আবাসস্থল।

ফলস্বরূপ এরা প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে ৩৬ প্রজাতির ব্যাঙ! ৪৮৯ প্রজাতি রয়েছে ‘মহাবিপন্ন’ তালিকায়! অর্থাৎ এখনই যদি আমরা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারি তাহলে এরাও একদিন হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে।

অনেকেই জানেন না, ব্যাঙ আসলে আমাদের ঠিক কী উপকারে লাগে? যে কারণে ব্যাঙ হারিয়ে গেলে কী হবে সেই ব্যাপারে আমরা অনেকেই উদাসীন!

এ বিষয়ে আমি ছোট্ট একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করবো। লোকটির নাম রহমত আলী। পেশায় কৃষক। সিলেট শহরের পাশ্ববর্তী গ্রামে তার বসবাস।   নিজের জমিতে জাষাবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।

কথা প্রসঙ্গে রহমত আলী জানান, আগে ধান খেতে প্রচুর সংখ্যক ব্যাঙ দেখ‍া যেতো। ব্যাঙগুলো খেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে রক্ষা করত।

ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একসময় তিনি রাসায়নিক সার ব্যবহার শুরু করলেন এবং জমিতে কিটনাশক প্রয়োগ করতে লাগলেন। ফলস্বর‍ূপ বছর খানেকের মধ্যেই তার ধান খেতে ব্যাঙের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে লাগল। জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের আগে তার জমিতে কখনো কিটনাশক ব্যবহার করতে হয়নি।

 এ থেকেই ব্যাঙের এই ছোটখাট উপকারের দিকটি আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

এছাড়াও ব্যাঙ আমাদের খাদ্যজালের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর অনুপস্থিতিতে একদিকে যেমন এর ওপর নির্ভরশীল প্রাণীদের সংখ্যা কমে যাবে, তেমনি যেসব ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে এরা পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতো সে ধরনের পোকাড়ের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ‍

আবার ব্যাঙকে আমরা বলে থাকি ‘বায়োইন্ডিকেটর’, এর কারণ হলো যদি কোনো পরিবেশে ব্যাঙের সংখ্যা পর্যাপ্ত থাকে তাহলে সেই পরিবেশ ভারসাম্যপূর্ণ আছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। কারণ পরিবেশের কোনো ধরনের নেতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যাঙ খুব দ্রুত সাড়া (রেসপন্স করে) দেয়। যার অর্থই হলো যদি পরিবেশে কোনো ধরনের ক্ষতিকারক কিছু ঘটে তাহলে সেখান থেকে ব্যাঙ’র সংখ্যা খুব দ্রুতই কমে যাবে! যেটা আমরা এখন দেখছি!!

মূলত কৃষি জমিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সারের ব্যবহার, জলাশয় ভরাট, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বনভূমি উজার হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি কারণে ব্যাঙের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই অবৈধভাবে ব্যাঙ ধরে তা বাণিজ্যিক রেস্তোরাঁয় বিক্রি করা হয়।

শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ব্যাঙ নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ‘ব্যাঙ চাষ’ শুরু হয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ব্যাঙ কেটে বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয় যা প্রকারান্তরে ব্যাঙের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশে এক সময় এ ধরনের কাজ হলেও বর্তমানে পাঠ্যক্রমে ব্যাঙ কেটে ব্যবহারিক ক্লাস করাকে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে।

পৃথিবীতে ব্যাঙের সংখ্যা যখন কমে যাচ্ছে সেখানে অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও আয়োজন করা হচ্ছে  ‘সেভ দ্য ফ্রগস ডে’ নামক এক অন্যরকম দিবসের। ২৩টি দেশের ১৪০টি স্থানে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে এ বছর। গত ৬ বছর ধরেই পাল করা হচ্ছে এ দিবস। মূলত ব্যাঙ রক্ষায় বিশ্ববাসীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এ আয়োজন।

প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ শনিবার এই আয়োজন হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিভাসুসহ দেশের অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘সেভ দ্য ফ্রগস ডে’।

তবে শুধু একটি দিনের মধ্যে যেন ব্যাঙ রক্ষার এই মন্ত্র সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং ব্যাঙের উপকারের কথা বিবেচনা করে  এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এর অসামান্য অবদানের কথা মনে রেখে ব্যাঙকে ‘সেভ’ করা এখন সময়ের দাবি। আসুন ভালোবাসায় টিকিয়ে রাখি আমাদের ছোট্ট এই উপকারী বন্ধুটিকে ।

অনিমেষ ঘোষ
(প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, লাউয়াছড়া ফ্রগ রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ)
শিক্ষার্থী-বনবিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ
শাবিপ্রবি, সিলেট।
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।