ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

হাতের মুঠোয় ছোট্ট প্রাণ

ইনাম আল হক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৪
হাতের মুঠোয় ছোট্ট প্রাণ সাইবেরিয়া থেকে আসা হলদেভ্রু-ফুটকি / ছবি : ইনাম আল হক

ঢাকা: একটি পাখি হাতে নিয়ে আমি হতবাক হয়ে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। পাখিবিদ ফিলিপ রাউন্ড বললেন, ‘কি হলো? পাখিটি প্রোসেস করছেন না যে!’ আমতা-আমতা করে আমি বললাম, ‘করব; কিন্তু একমুঠো পালক ছাড়া আমার হাতে কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না!’

আমার হাতের মুঠোয় স্থির হয়ে বসে ছিল একটা হলদেভ্রু-ফুটকি পাখি।

এ পাখি আমি আগে দেখেছি বহুবার; কিন্তু হাতে পেলাম এই প্রথম। বর্ষা থেমে গেলে প্রতি বছর এ পাখি বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা মহানগরীর রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন অথবা জাবি ক্যাম্পাসে গিয়ে একটু খুঁজলেই আমরা এদের দেখা পাই।

উত্তুঙ্গ হিমালয় পর্বত পার হয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার উড়ে এরা এখানে আসে। বছরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় এরা এখানেই বাস করে; কিন্তু বর্ষা এলে উত্তরমুখো উড়ে যায়, সদ্য বরফমুক্ত সাইবেরিয়া গিয়ে বাসা বাঁধে।

আমরা ছয় জন পাখি-সন্ধানী মানুষ হাইল-হাওরের উত্তরে হিজল ও করচ গাছের বনে বসে আছি ডিসেম্বর মাসের কুয়াশা-মোড়া প্রত্যুষে। বাইক্কা বিলে আমাদের পাখি-গবেষণার ছিল দ্বিতীয় দিন। আলো ফুটতে না ফুটতে আমরা পাখি ধরার বিশেষ জাল ‘মিস্ট-নেট’ প্রসারিত করে দিয়েছি।

 

প্রথম দিনের কাজের শেষে সব জাল গুটিয়ে রাখা হয়েছিল। ঢোল-কলমি ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে টাঙানো প্রায়-অদৃশ্য এই জাল থেকেই আমরা পাখি পাই। আর পেলেই আমরা তাকে দ্রুত ‘প্রসেস’ করি। প্রসেস করা হলো- শনাক্তকারী নম্বর হিসেবে একটি আংটি পায়ে পরিয়ে, দেহের মাপজোখ নিয়ে আর ছবি তুলে পাখিকে মুক্ত করা।
 
গাছের পাতায় লেপটে থাকা পোকামাকড়ই ‘ফুটকি’ পরিবারের অধিকাংশ পাখির প্রধান আহার্য। বিজ্ঞানীরা এ পাখিদের জেনেটিক নাম দিয়েছেন ‘ফাইলোস্কোপাস’; অর্থাৎ ‘পল্লব-পরীক্ষক’। গাছের পাতা-খেকো পোকা নিয়ন্ত্রণ করাই এর কাজ।


পল্লব পরীক্ষার সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে সকালবেলা এদের বেশি-ক্ষণ দূরে রাখা ঠিক নয়। এ পাখি হাতে পেলে তাই ঝটপট প্রসেস করা উচিত।
 
ফিলিপ রাউন্ডের কথায় বুঝলাম, হলদেভ্রু-ফুটকি পাখিটি হাতে নিয়ে আমি কালক্ষেপ করেছি। আমার ঢিলেমির কারণ, সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা একটা পাখি যে এত হালকা হতে পারে তা মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছে যেন বাতাসে উড়ে আসা কয়েকটা পালক ছাড়া আমার হাতে কিছু নেই!
তবুও, নির্ভার এই পালকের তলে কোথায় যেন একটা খুদে প্রাণ ধুক-ধুক করছে। কত ছোট একটা প্রাণ! ঊষর সাইবেরিয়াতে জীর্ণ-পাতার বাসায় বেত-ফলের মতো ছোট্ট একটি ডিমের ভিতর এই ক্ষীণ প্রাণ প্রথম স্পন্দিত হয়েছে জুলাই মাসের কোনো এক ঈষদুষ্ণ দিনে। সেই থেকে আজও চলছে অতি ছোট এ হৃদযন্ত্রটি: ধুক-ধুক, ধুক-ধুক...।
 
ছোট্ট দুটি ডানা হিমালয় পর্বত পার করে একে নিয়ে এসেছে ঢোল-কলমি দিয়ে ঢাকা বাইক্কা বিলের পাড়ে। কুয়াশা-ভেজা পাতায় প্রাতঃস্নান সেরে পাখিরা এখানে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বসে থাকে। সূর্য উঠলেই প্রান্তর জুড়ে শুরু হবে এদের পল্লব পরীক্ষার প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ। উষার আলো-আঁধারিতে পাতায় পাতায় তাই প্রতীক্ষার ঘড়ি চলে ধুক-ধুক, ধুক-ধুক...।
 
পায়ে আংটি পরিয়ে হলদেভ্রু-ফুটকি পাখিটিকে আমি ইলেকট্রনিক ব্যালান্সের ওপর রাখলাম। আংটিসহ এর ওজন হলো পাঁচ গ্রাম! পাঁচ গ্রাম? চা-চামচের এক চামচ চিনির ওজন পাঁচ গ্রাম! অনেকের চায়ে এর দ্বিগুণ চিনি লাগে। পাঁচ গ্রাম ওজনের পাখি কম করে হলেও পনেরো হাজার কিলোমিটার উড়ে এসেছে আমাদের এই বিলে!

সাইবেরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করার ক্ষণে সম্ভবত এর ওজন ছিল সাত গ্রাম। যাত্রাপথে এর ছোট্ট দুটি ডানায় শক্তি জোগাতে গিয়ে ক্ষয় হয়ে গেছে দুই গ্রাম। এখন শুধু ধুক-ধুক করে ধাবমান হৃৎপি-টি সচল রাখার শেষ শক্তিটুকু টিকে আছে এর দেহে। ঢোল-কলমির পাতায় পাতায় পর্যাপ্ত পোকা খুঁজে না পেলে কোনো এক শীতের রাতে হয়তো শেষ হবে ধুক-ধুক করে ধেয়ে চলা অকিঞ্চিৎকর এই প্রাণশক্তিটুকু। বনতলে পড়ে থাকবে ম্লান-সবুজ পালকে মোড়া এর প্রাণহীন দেহ; ওজন যার পাঁচ গ্রাম। মরদেহ সৎকারের জন্য সারি বেঁধে উপস্থিত হবে পাঁচ হাজার লাল-পিঁপড়া। তার পর বিলের বাতাসে উড়ে যাবে কাগজের মতো হালকা পালকগুলো; ম্লান-সবুজ আর হালকা-হলুদ যার রং।
 
আমার হাতের মুঠোয় ধরা হলদেভ্রু-ফুটকির জীবনের গল্পটি একেবারেই অন্যতর হতে পারে যদি বাইক্কা বিলে অক্ষত থাকে ঢোল-কলমির এ প্রান্তর। কলমির পাতায় প্রতিদিন পুষ্টিকর পোকা-মাকড় পেলে চার-পাঁচ মাসেই এ পাখিটির ওজন হবে সাত গ্রাম। মার্চ-এপ্রিল মাসেই সে প্রস্তুত হবে হিমালয় পর্বত পাড়ি দেওয়ার জন্য; এবং জুন মাসে তুষারমুক্ত সাইবেরিয়া গিয়ে জোড়া বাঁধবে আরেকটি হলদেভ্রু-ফুটকির সাথে।


বৃক্ষহীন প্রান্তরে শ্যাওলা, শুকনো-পাতা ও ঝরা-পালক জড়ো করে তারা গোল বলের মতো একটা বাসা বানাবে। সেই বলের ভিতর এক সময় দেখা দেবে বেত-ফলের মতো কয়েকটি সাদা ডিম। দিন-রাত সেই ডিমে তাপ দেওয়ার পর তার মধ্যে ধুক-ধুক করে স্পন্দিত হবে কয়েকটি খুদে প্রাণ।
 
দশ দিনের মধ্যে ডিমের খোসা ভেঙে ছানারা বেরুবে। দু-সপ্তাহ পর জীর্ণ-পাতার বাসা ছেড়ে তারা বেরিয়ে আসবে খোলা আকাশের নিচে। তার পর, মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতের দীর্ঘ বিপজ্জনক সফর শেষে হিমালয় পর্বত পার হয়ে বাইক্কা বিল পর্যন্ত জীবিত এসে হাজির হবে যারা সত্যিই সবল আর ভাগ্যবান।


এমনই সুন্দর আর সার্থক জীবন কামনা করে হাতের পাখিটিকে আমি মুক্ত করে দিলাম। অমনি সে ‘সি-ইউ’ বলে ডাক ছেড়ে উড়াল দিয়ে হারিয়ে গেল ঢোল-কলমির ঝোপে। পায়ে রইল আংটি নম্বর AAA009।
 
সাইবেরিয়ায় জন্ম নেওয়া ফুটকি, চুটকি ও দামা পরিবারের অগুনতি পরিযায়ী পাখির জীবন-কাহিনীর সাথে বাংলাদেশের ঢোল-কলমি ঝোপগুলো যে কত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সে কথা অনেকেই হয়তো জানেন না। আপন তেজে ছড়িয়ে পড়া নমনীয় এই উদ্ভিদকে এ দেশের মানুষ আগাছা মনে করেন।
প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঢোল-কলমির ঝোপে দা-এর কোপ দিতে কেও দু’বার চিন্তা করেন না। কলমির পাতায় বাস করা কোনো কীটের কারণে ‘ঝিনঝিনে’ নামের এক আজব রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ায় বছর দশেক আগে দেশব্যাপী এর নিধন-যজ্ঞ চলেছিল।

হাইল হাওরে পাখি দেখতে গিয়ে আমরা এখনও ঢোল-কলমির ঝোপে আগুন জ্বলতে দেখি। কে বা কারা আগুন দিয়েছে, তা জানতে পারি নে। AAA009 নম্বর আংটি-পড়া হলদেভ্রু-ফুটকির জীবনের ছোট্ট এ গল্পটি কী তাদের কাউকে কোনো দিন ঢোল-কলমির ঝোপগুলোকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে উদ্বুদ্ধ করবে!
 
উদ্ভিদ ও পাখির তথ্য:

হলদেভ্রু-ফুটকি   Yellow-browed Warbler  Phylloscopus inornatus
ঢোল-কলমি  Ipomea fistulata
হিজল  Indian Oak  Barringtonia acutangula
করচ  Indian Beech  Millettia pinnata (Pongamea pinnata)



 

ইনাম আল হক, বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ, প্রকৃতিপ্রেমী। বাংলাদেশের পাখি ও প্রকৃতি রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন-চ্যানেল আই 'প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক-২০১৩' প্রাপ্ত।

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।