ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

হাওরের মণি-মুক্তো

প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে স্ট্রবেরি-গোলাপ!

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৪
প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে স্ট্রবেরি-গোলাপ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টাঙ্গুয়ার হাওর (সুনামগঞ্জ) থেকে ফিরে: অনেকেই মনে করেন গোলাপের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যগত কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে স্থানীয়ভাবে চাষ করা গোলাপের সবটুকুই ধার করা।

তাছাড়া গোলাপের আদিস্থান বলতেও মধ্য এশিয়া বা ইউরোপের দেশগুলোকেই বোঝায়। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হলো, আমাদের প্রকৃতিতেও আছে এখানকার নিজস্ব একটি বুনো গোলাপ। আর ফুলটির আবাসস্থল খোদ সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরেই!

শুধু তা-ই নয়, ধারণা করা হয় যে, এটাই পৃথিবীর একমাত্র জলসহিষ্ণু গোলাপ। জানা মতে, টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়া দেশের আর কোথাও এ গোলাপ দেখা যায় না। জলসহিষ্ণু হওয়ায় বছরের দীর্ঘ সময় পানির নিচেই ডুবে থাকে। পানি সরে গেলে ধীরে ধীরে নতুন পাতা ও ফুলের কুঁড়ি গজাতে শুরু করে। বুনো গোলাপ জন্মে হাওরের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে। শুকনো মৌসুমে এসব স্থান বিচিত্র তৃণ-গুল্মে ভরে ওঠে। আশপাশে খুব একটা বসতি না থাকায় সাধারণত নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন নেই।

শুধু বুনো গোলাপই নয়, টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে বুনো স্ট্রবেরিও। এটাও আমাদের জন্য আরেকটি বড়সড় সুসংবাদ। তাহলে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি যে, শুধু শীতের দেশই নয়, গোলাপ আর স্ট্রবেরি আমাদের মতো গরমের দেশেও প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। এমন একটি বড় খবর নিয়ে আমাদের দেশে এখনো কোনো হইচই হয়নি!

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বুনো গোলাপ আর স্ট্রবেরির সন্ধানে ছুটে গিয়েছি টাঙ্গুয়ার হাওরে। সোলেমানপুর বাজার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলার পর বামপাশে একটি হিজলের বনে থামি। হুড়হুড়ি আর ঘাগরার পাশে খুঁজে পাই গোলাপের একটি ঝোপ।

হায়, গাছে দুটো বাসি ফুল শুকিয়ে আছে। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি আশপাশের ঝোপঝাড়ে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যাই। কি আনন্দ! আমার ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে বুনো গোলাপ! বেঙ্গল রোজ। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দুটো ঝোপের একটি ফুল ভরতি, অন্যটিতে একটি মাত্র ফুল।

ছবি তুলে নৌকায় ফিরি। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাই গোলাবাড়ি ক্যাম্প লাগোয়া বাঁধে। নৌকা রেখে হাঁটতে শুরু করি। হাওরের এদিকটা বেশ নির্জন। হিজল, করচ, বরুণের দীর্ঘ সারি। পাশেই ঢালু অংশে বিচিত্র লতাগুল্মের ঠাঁসবুনন। সেদিকে চোখ রেখেই হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাই তিন শিশুকে। ওরা ক্ষুদে রাখাল। হাওরে গরুর পাল ছেড়ে দিয়ে খেলাধুলায় ব্যস্ত।

আমরা কি খুঁজছি জানতে চাইলে বুনো স্ট্রবেরির একটি ছবি ওদের দেখাই। ওরা সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারে। আমাদের সঙ্গে উৎসাহ নিয়ে খুঁজে বের করে স্ট্রবেরি। এই স্ট্রবেরি নাকি ওদের পছন্দের ফলও। বিস্তীর্ণ এলাকায় স্ট্রবেরির ফুল ও ফল ছড়িয়ে আছে। তবে আকারে ছোট হওয়ায় একটু ভালোভাবে লক্ষ্য রাখতে হয়।

আরো খানিকটা এগিয়ে আরেকটি দুর্লভ ফুল পেলাম। এই ফুলটি দেখেছি নিউইয়র্কের ব্রুকলিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ফুলটি পটকার মতো, কিন্তু গাছটি লতানো। আরো অনেকটা পথ হেঁটেও পটকালতার আর কোনো গাছ পাইনি। সে হিসেবে গাছটি বিপন্ন প্রজাতির হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। যদিও আইইউসিএনের চেকলিস্টে এ গাছের নাম নেই।

পথে পথে গোলাপের আরো কয়েকটি ঝোপ চোখে পড়ে। ধ্বংসপ্রায় নলখাগড়ার ঝোপে বেশ কিছু সুদৃশ্য দুধিয়ালতা জাঁকিয়ে বসেছে। বেগুনি রঙের হুড়হুড়ির বন বিক্ষিপ্ত বাতাসে দোল খাচ্ছে। বরুণের গুচ্ছবদ্ধ ফুল চারপাশ আলোকিত করে রেখেছে। হিজল গাছগুলো দীর্ঘ প্রস্ফুটনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা আরো কিছু মণি-মুক্তো কুড়ানোর আশায় হাঁটতে থাকি।

এবার বনগোলাপ ও স্ট্রবেরির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আবশ্যক
বনগোলাপ
বনগোলাপের প্রচলিত আরেকটি নাম সেঁউতি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
‘আমি জানি মনে-মনে,
           সেঁউতি যূথী জবা’।

বলিষ্ঠ ঝোপালো গুল্ম। খাঁড়া বা অর্ধ-আরোহী ধনুকের মতো শাখা-প্রশাখা যুক্ত। চ্যাপ্টা কাঁটা উপপত্রের জোড়ায় থাকে। পাতা ৫ থেকে ১০ সেমি লম্বা, পত্রক ৭ থেকে ৯টি, সামান্য বৃন্তক। পাতা ও ডালপালা রোমশ বা মসৃণও হতে পারে। পত্রক সাধারণত এক জোড়া বা উপপত্রের নিচে সোজা, চ্যাপ্টা, কণ্টকিত, উপপত্র ছোট, ঝালর সদৃশ।

পুষ্পবৃন্তযুক্ত, মঞ্জরিদণ্ড বলিষ্ঠ, পত্র থেকে অনেক ছোট, পুষ্পবৃন্ত ছোট, মঞ্জরিপত্র দেড় সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ঘনভাবে ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত। বৃতিনল গোলাকার। বাইরের দিকটা বাদামি, খণ্ডক দেড় সেন্টিমিটারের মতো, ডিম্বাকার, ভেতরে রোমশ, ক্ষণস্থায়ী। পাপড়ি সংখ্যা ৫, রং সাদা, ১.৭ থেকে ৩ সেমি লম্বা, প্রশস্তভাবে বিডিম্বাকার, শীর্ষ সখাঁজ ও মসৃণ। পুংকেশর অসংখ্য, গর্ভদণ্ড মুক্ত। ফল ১ থেকে ২ সেমি লম্বা, গোলাকার, ঘনভাবে কোমল রোমাবৃত। ফুল ও ফলের মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে জুন।

বাংলাদেশ ছাড়া ভারত এবং মায়ানমারেও এ গোলাপ অল্প সংখ্যক দেখা যায়। বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভূক্ত। বৈজ্ঞানিক নাম Rosa clinophylla. (Rosa involucrata)|

বুনো স্ট্রবেরি
বাঁকা ধাবকযুক্ত, বর্ষজীবী বা বহুবর্ষজীবী লতানো গাছ। সাধারণত মাটিতে গড়ায়। স্বভাবে অনেকটা থানকুনি গাছের মতো। কাণ্ড অনেক, লম্বা, সরু ও রোমশ। পত্র আঙ্গুলাকারে ৩ থেকে ৫ পত্রক, পত্রবৃন্ত ২ থেকে ১২ সেমি লম্বা, খুব সরু, রোমশ, উপপত্র পত্রাকার, পত্রক ডিম্বাকার ও ঝিল্লিময়, দ্বি-খাঁজকাটা, শিরা পক্ষল অপসারী, ওপরের গা লম্বা সাদা রোমযুক্ত এবং প্রান্ত সিলিয়াযুক্ত। ফুলের রঙ হলুদ, আড়াআড়ি, দেড় থেকে আড়াই সেমি, লম্বা কাক্ষিক মঞ্জরিদণ্ডে একক। মঞ্জরিপত্রিকা বড়, বিডিম্বাকার, অখণ্ডিত, বৃতি নলের অধিকাংশ ছাড়িয়ে যায়।

বৃত্যংশ রোমশ ও স্থায়ী। পুংকেশর অসংখ্য, এক সারিতে বিন্যস্ত, স্থায়ী, পুংদণ্ড সূত্রাকার, পরাগধানী জোড়ায় জোড়ায় বিন্যস্ত। ফুল ও ফলের মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে জুন। এই স্ট্রবেরি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে দেখা যায়। এক সময় বৃহত্তর সিলেট ছাড়াও দেশের আরো কয়েকটি স্থানে দেখা যেতো। স্থানীয়রা জিহ্বার ক্ষত সারাতে এফল ব্যবহার করেন। বৈজ্ঞানিক নাম Duchesnea indica| ।
    
হাওরের আরো সহজলভ্য কিছু তৃণ-গুল্মের মধ্যে আছে মটমটিয়া, ভাঁট, বিষকাটালি, নলখাগড়া, পটপটি, পটাস, ডোলকলমি, ঝুনঝুনি, জলকলমী, শাপলা, শালুক, চাঁদমালা, বেত, ছেঁচরা, পানিকুলা, কালোকুঁচ, বড়নখা, হাতিশুঁড়, লজ্জাবতী, হুড়হুড়ি, পাটিবেত, ভেন্না ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।