বাগেরহাট: ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’ সুন্দরবন নিয়ে প্রবাদটি হয়তো সবার জানা। জীববৈচিত্রের বিচিত্র সমাহার সুন্দরবনের বৈচিত্রময় প্রকৃতির মাঝে একটু-আধটু অনিরাপত্তার কথা জেনেই সবাই আসে সুন্দরবন ভ্রমণে।
বনদস্যু আর জলদস্যু ছাড়াও অবৈধ শিকারী ও কাঠ পাচারকারী চক্র এখন বেপরোয়া সুন্দরবনে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে র্যাবের ধারাবাহিক অভিযানের কারণে বর্তমানে সুন্দরবনে দস্যুরা কিছুটা কোণঠাসা থাকলেও শিকারী আর পাচারকারী চক্র প্রতিদিন বন থেকে পাচার করছে বিভিন্ন বন্য প্রাণী, পাখি ও মূল্যবান কাঠ। ফলে, বন উজাড়ের পাশাপাশি হারাচ্ছে আমাদের জীব বৈচিত্রের সমাহার।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বনে শিকারীদের প্রধান টার্গেট হল হরিণ, কুমির, ভোদড়, বাঘ, গুইসাপ, কচ্ছপ প্রভৃতি। এছাড়া গোলপাতা আহরণের আড়ালে প্রতিবছর কয়েক লাখ ঘন ফুট সুন্দরী, গেওয়া, গরানসহ সুন্দরবনের কর্তন নিষিদ্ধ কাঠ পাচার হচ্ছে।
শুধু মাত্র অর্থের লোভে এতে সহযোগিতা করছে বন সংলগ্ন নিম্নবিত্তের মানুষ এবং বনের উপকরণ নির্ভরশীল জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরা। আর এসব পাচারের সঙ্গে বনবিভার এবং স্থানীয় প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগও বেশ পুরনো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কাঠুরিয়া বাংলানিউজকে জানান, গোলপাতর সঙ্গে বন থেকে যে বিভিন্ন ধরনের কাঠ আসে তা বন কর্মকর্তাদেরও জানা। আর এর জন্য তাদের (বনবিভাগ) খুশি রাখার ব্যাবস্থা করতে হয় তাদের।
তিনি জানান, বন থেকে যেসব বড় বড় নৌকা ও ট্রলার করে গোলপতা আনা হয় তার প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই আসে বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ। আর যারা বনবিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে কাঠ সংগ্রহ করে তারাও অনুমতির বাইরে কয়েকগুণ বেশি কাঠ আহরণ করে।
সাধারণত এসব নৌকা ও ট্রালারের দু’পাশে পানির নিচে ডুবিয়ে এবং গোলপাতর নিচে নিচে সাজিয়ে এসব কাঠ অনা হয় বলে জানান তিনি।
তবে, তাদের সঙ্গে হরিণসহ বন্য প্রাণী শিকার চক্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দবি করেন তিনি।
সুন্দরবনের দুবলার চর এবং নারিকেলবাড়িয়া জেলে পল্লির একাধিক জেলে জানায়, শুটকি মৌসুমে সুন্দরবনের শুটকি পল্লি থেকে বর্তমানে নৌ-পথে (সমুদ্রপথে) ভারত ও থাইল্যান্ডে পাচার হচ্ছে ।
এসব বিষয়ে মংলার কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের গোয়েন্দা কর্মকর্তা (মিডিয়া) প্রশান্ত কুমার রায় বাংলানিউজকে বলেন, বন্য প্রাণী এবং বনজ সম্পদ রক্ষায় কোস্টগার্ড সব সময় সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন কারছে। এ ধরণের যেকোন প্রকার অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার অভিযান পরিচালনা করেন।
নিয়মিত টহল এবং অভিযানের কারণে বর্তমানে পাচারকারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ছে।
তিনি জানান, সুন্দরবনে দস্যুতা দমনের পাশাপাশি বন্য প্রণী এবং বনজ সম্পদ পাচার প্রতিরোধ ও পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে কোস্টগার্ড সর্বদা বনবিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করে চলেছে। যার ফলে বিভিন্ন সময় উদ্ধার হচ্ছে কর্তন নিষিদ্ধ সুন্দরী কাঠ, হরিণ, হরিণের মাংস ও চামড়া।
তবে, সুন্দরবনের শুটকিপল্লি থেকে সরাসরি নৌ-পথে ভারত ও থাইল্যান্ডে শুটকি পাচারের ব্যাপারে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার কথা জানান তিনি।
বাংলানিউজকে প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, সুন্দরবন থেকে সম্প্রতি কুমির, ভোদড়, গুইসাপ, কচ্ছপ পাচার হচ্ছে বলে তারাও বিভিন্ন সময় খবর পাচ্ছেন। নৌপথে বিদেশে শুটকি পাচার, বন্য প্রাণী শিকার এবং পাচার প্রতিরোধে নিয়মিত নজরদারি সঙ্গে সঙ্গে বনজীবী ও জেলেদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শিকারীদের তৎপরতার কথা অস্বীকার না করলেও পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) চৌধুরী আমির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বন্য প্রাণী বিক্রি ও পাচার রোধে তাদের মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন থেকে গোলপাতা ছাড়া অন্য কোনো প্রকার গাছ কাটার অনুমতি প্রদান করা হচ্ছে না। গোলপাতার নৌকাগুলো সাধারণত বড় হওয়ায় সব নৌকা তল্লাশি করার সম্ভব হয় না। কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গোলপাতার আড়ালে অনান্য গাছ কেটে আনার চেষ্টা করলেও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এগুলো করে না।
সুন্দরবনে শুটকি শুকানোর পর ওজন করে নির্দিষ্ট রাজস্ব পরিশোধের পর বনবিভাগ শুটকিপল্লি থেকে তা পরিবহনে অনুমতি দেয়। তবে, সমুদ্র পথে শুটকি বিদেশে পাচার হচ্ছে এমন কোনো কথা তাদের জানা নেই।
আর কচ্ছপ ও অন্য প্রাণী পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত শীতকালে জেলেদের জালে কচ্ছপ বেশি ধরা পড়ে। বনবিভাগ এ ব্যাপারে জেলেদের সচেতন করা হচ্ছে। আর বন থেকে যেকোনো বনজ সম্পদ পাচারের ব্যাপারে তারা সবসময় তৎপর এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বাংলানিউজকে জানান, এ ক্ষেত্রে বনবিভাগের কোনো কর্মকর্তা কোনো প্রকার অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বাংলানিউজের কাছে বনজ সম্পদ এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু মাত্র আইন এবং আইন প্রযোগ করে বনজ সম্পদ পাচার এবং এর জীববৈচিত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়। দরকার বন সংশ্লিষ্ট এবং সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বনজ সম্পদ ও বনের জীববৈচিত্র রক্ষার প্রযোজনীয়তা সম্পর্কে তাদের উদ্বুদ্ধ করা।
এক্ষেত্রে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে, বাওয়াল, মৌয়াল এবং বন সংলগ্ন স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৪