ঢাকা, বুধবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ মে ২০২৪, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

রাতারগুলে ওয়াচ টাওয়ার

জীববৈচিত্র্যে হুমকি দেখছেন না গবেষকরা

সাব্বির আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৪
জীববৈচিত্র্যে হুমকি দেখছেন না গবেষকরা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

সিলেট: জলা বন রাতারগুলে ‘বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য’ গড়ে তুলতে নির্মাণ করা হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার ও স্টাফ কোয়ার্টার। এতে জলাবনটির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

তবে বনবিভাগ, বনের সৌন্দর্য দেখা ও পর্যবেক্ষণ সুবিধার জন্য এটি নির্মাণ করছে এবং এতে বনের ক্ষতি হবে না বলে জানিয়েছে।

এদিকে পরিবেশবিদ, প্রকৃতিপ্রেমী ও বন্যপ্রাণী গবেষকরা বনে যেকোনো স্থাপনা বন্যপ্রাণির জন্য ঝুঁকি উল্লেখ করে বলছেন, বন দেখার জন্য ওয়াচ টাওয়ার দরকার, তবে এটা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে বনের কোনো ক্ষতি না হয়।

বন কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যটকদের অবাধ বিচরণ ঠেকাতে এবং তাদের সুবিধার্থে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, রাতারগুলের জলাবনকে ‘বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য’ হিসেবে গড়ে তুলতে ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পে বনায়ন খাতে ৩০ লাখ টাকা, বাকি অর্থের মধ্যে সরবরাহ ও সেবা খাতে ২৫ লাখ, মেরামত, সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন খাতে ৩৩ লাখ, সম্পদ সংগ্রহ ও ক্রয় বাবদ ৫৮ লাখ এবং নির্মাণ ও পূর্ত খাতে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়।

রাতারগুল জলাবন নিয়ে গত বছর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ১২টি প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পর্যটনের নামে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা।

এ ব্যাপারে রাতারগুল বন বিট কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, রাতারগুলে অপরিকল্পিত কোনো স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে না। বনবিভাগ প্রকল্প প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পর্যটকদের সুবিধার্থে বনের ভেতরে ফাঁকা স্থান নির্বাচন করে ওয়াচ টাওয়ার করছে। আর বিট অফিসের পাশেই স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ শেষ হওয়ার পথে।

তিনি জানান, এর ফলে বনে পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ হবে।   এছাড়া বন রক্ষায় লোকালয় ও বনের মাঝামাঝি এলাকায় একদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হবে। যাতে লোকালয় থেকে কেউ বনে ঢুকে শিকার ও বনের সম্পদ নষ্ট না করতে পারে। তবে বাকি তিনদিকে বন উন্মুক্ত থাকবে। যেদিকে কাঁটাতারের বেড়া হবে সেদিকটা উঁচু এবং গ্রাম এলাকা। তাই বন্যপ্রাণীর এতে ঝুঁকি থাকবে না। আর স্টাফ কোয়ার্টারটি বিট অফিসের কাছাকাছি নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান-বন বিট কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি ও পাবলিক হেলথ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সায়েম উদ্দিন আহমদ বলেন, ওয়াচ টাওয়ার এত বড় কোনো স্থাপনা নয় যে এটা বনের ক্ষতি করবে। ওয়াচ টাওয়ারের হবে বন পর্যবেক্ষণ করা এবং বনের সৌন্দর্য দেখার জন্য।

এর উপকারের দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ওয়াচ টাওয়ার হলে বন্যপ্রাণি শিকারীরা আর বনে শিকারে আসতে পারবে না। দূর থেকে বন পর্যবেক্ষণটা সহজ হবে।  

এটা বন বিভাগের একটি ভালো উদ্যোগ বলেই মনে করেন এই অধ্যাপক। এছাড়া গবেষণা ও বন্যপ্রাণী গণনার কাজেও ওয়াচ টাওয়ার কাজে আসে বলে জানান তিনি।

বিশ্বের বিভিন্ন বনে গবেষণার কাজে ঘুরেছেন ড. সায়েম উদ্দিন আহমদ । সাউথ আফ্রিকা ও কেনিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সেখানেও বনে ওয়াচ টাওয়ার করা হয়েছে। সেখানকার মানুষ সচেতন এবং বন্যপ্রাণিরাও নিরাপদে আছে।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিন এবং অর্নিথোলজিস্ট ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান বলেন, স্থাপনা গড়লে বনের ক্ষতি হবে, তবে বন দেখার জন্য এগুলো দরকার।

রাতারগুলের ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশ্য ভালো মন্তব্য করে তিনি বলেন, আরও যেসব বনে ওয়াচ টাওয়ার দেখা যায় সেখানে লোকজন জড়ো হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এ কারণে ওয়াচ টাওয়ার না হলেই ভালো।

দেশের প্রথম লেজবিহীন উভচরের আবিষ্কারক তানিয়া খান বলেন, ওয়াচ টাওয়ার সৌন্দর্য দেখার জন্য করা হচ্ছে, তবে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।

যারা বন দেখতে চায় এটা তাদের জন্য ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে একজন পর্যটক নিজে নিরাপদ থাকে, বনও নিরাপদ থাকবে।   তবে ওয়াচ টাওয়ারে যাতে কোনো ভাবেই দাবা খেলা না হয় বা মাইক লাগানো না হয়।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের প্রভাষক আমিনুর রশিদ বলেন, বনের নিরাপত্তায় ওয়াচ টাওয়ার ভালো। এর ফলে পর্যটক নৌকা নিয়ে বনের ভেতরে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা না করে ওয়াচ টাওয়ারে সময় কাটাবে। ফলে পানিতে মানুষের হৈ-হুল্লোড় কমে যাবে। যা বনের জলজ উদ্ভিদ ও মৎস্য সম্পদের জন্য ভালো।

আমিনুর রশিদ জানান, পানিতে মানুষের চলাফেরা ঘটলে মাছের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। মাছের চলাচলে  ব্যাঘাত ঘটে। তাছাড়া পানি দূষণের কারণে জলজ উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর ক্ষতি হয়।  

সিলেটে প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করছে ‘প্রাধিকার’। এর সভাপতি রাহুল দাস তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ জরুরি, তবে খেয়াল রাখতে হবে যে নির্মাণের সময়ে বনের স্বাভাবিক পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হলে দর্শনার্থীরা আর বনের গভীরে না গিয়েও এ বনের সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন, এতে বন্যপ্রাণীরাও নিরাপদে থাকবে।

সিলেটের পর্যটনকর্মী আহমদ সালিম সারওয়ার বাংলানিউজকে বলেন, পর্যটক আকর্ষণের জন্য দু’এক বছর ধরে রাতারগুলে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করছে। ওয়াচ টাওয়ার না থাকায় শত শত নৌকা এদিক সেদিন ঘোরাফেরা করে বনের নির্জনতা বিনষ্ট করছে।

কেউ কেউ আবার পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট বনের ভেতরে ফেলে আসছে। কিন্তু ওয়াচ টাওয়ার হলে বনে মানুষের ছোটাছুটি কমে আসবে যা বন রক্ষা ও পর্যটকদের বন দেখার সুবিধা করে দেবে।

গত বছর আগস্ট মাসে বাংলানিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে নৈঃশব্দের ভাষা হারানো রাতারগুলের চিত্র। সরেজমিনে দেখা যায় ক্রমেই বিনষ্ট হচ্ছে এর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। পর্যটকদের অবাধ বিচরণ, জলাভূমির মাঝে মাচা তুলে গান বাজনা, গাছ কাটা, এমন কি বিট অফিসের সামনে মাইক বাজিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছিল প্রাণিদের অবাধ বিচরণ। নামে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হলেও চোখে পড়েনি তার কোনো তৎপরতা। সেক্ষেত্রে ওয়াচ টাওয়ারে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে এ অবস্থার অনেকটাই সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।    

বাংলাদেশ সময়:  ১০২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।