ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বিদেশি টাকা ও পরামর্শকদের খপ্পরে যেন না পড়ি

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৪
বিদেশি টাকা ও পরামর্শকদের খপ্পরে যেন না পড়ি ফিলিপ গাইন

ফিলিপ গাইন পরিবেশ, মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেন। ছবি তোলেন মানুষ ও প্রকৃতির।

পরিবেশ, অরণ্য, আদিবাসী, নির্বাচন ও মানবাধিকার বিষয়ে এপর্যন্ত ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন। এছাড়া সাতটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছেন বন, আদিবাসী, চিংড়িচাষ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং চা-শ্রমিকদের নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ (১৯৮৭); ১৯৮৯ সালে অশোকা ফেলো; ১৯৯৩ সালে আলফ্রেড ফ্রেন্ডলি প্রেস ফেলো (ইউএসএ); এবং ২০০২ সালে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড ফেলো। ১৯৯৩ সাল থেকে সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের নানা দিক নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলানিউজের ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপনডেন্ট মোকারম হোসেন

বাংলানিউজ: আপনি প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে কী কাজ করেছেন?

ফিলিপ গাইন: প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে আমার আগ্রহ, কাজ মানবাধিকার এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে আদিবাসী ও অরণ্য এ দুটো ক্ষেত্রে কাজের কারণে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপারে আমার আগ্রহ। পরিবেশ, অরণ্য ও আদিবাসী- এ তিনটি ক্ষেত্রে আমি কাজ করি দুই দশকের বেশি সময় ধরে, এখনো করছি। এর মধ্যে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য সবসময় আছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক অরণ্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে গত দুই দশকে, সেই সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য। এর জন্য দায়ী অনেক কারণ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদেশি প্রজাতি দিয়ে সরকারি বনভূমিতে সামাজিক ও শিল্প বনায়ন। বিদেশি প্রজাতির আগ্রাসনে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া চিংড়ি চাষ, রাবার চাষ ও তামাক চাষের কারণেও আমাদের উপকূল ও পাহাড়ের অরণ্য এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বর্তমানে নানা অনুসন্ধানের কাজ করছি, রিপোর্ট করছি। এছাড়া পরিবেশ নিয়ে আমার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট: ফেসিং দি টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’র তৃতীয় সংস্করণের কাজ করছি যার মধ্যে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

বাংলানিউজ: আপনি আমাদের বন-পাহাড়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন, সেখানে গিয়ে আপনার কী মনে হয়েছে?

ফিলিপ গাইন: আমাদের বন-পাহাড়ের অবস্থা খুব করুণ। ঐতিহ্যবাহী শালবনের খুব বেশি হলে ১৫ শতাংশ অবশিষ্ট আছে। মধুপুর আজ  কলা, আনারস ও আদা-হলুদের বাগান। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো ন্যাড়া। সেখানকার সর্বশেষ গাছগুলো উজাড় হচ্ছে এখন। বহিরাগতরা পাহাড়ের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। রাবার ও তামাক চাষসহ অনেক বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য দ্রুত নিঃশেষ হচ্ছে পাহাড়ে।

প্রাণসংহার করে ক্ষান্ত হচ্ছে না আগ্রাসীরা; তারা পাহাড় কাটছে, পাহাড়ি নদী ও ছড়া থেকে পাথর তুলে নিয়ে আসছে। পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও বাঁচার অন্যান্য উৎসসমূহ নষ্ট হচ্ছে। বন-পাহাড়ের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে পাহাড়ের মানুষ ও অরণ্যবাসীর শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি জড়িত। বন ও পাহাড় নষ্ট হওয়ার কারণে তাদের সেই জ্ঞান, শিক্ষা, এবং সংস্কৃতিও নষ্ট হচ্ছে। এখানে রাষ্ট্র ও সখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অবহেলা ও অপরাধ করছে। এর অবসান কীভাবে হবে জানি না। তবে ব্যবস্থা আমাদেরই নিতে হবে।

বাংলানিউজ: আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমি সুরক্ষার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?
 
ফিলিপ গাইন: বন রক্ষার জন্য যা যা করা দরকার তা সময়মত করা হয়নি। বরং বনবিনাশী অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়। এক্ষেত্রে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে কোনো ধরনের বনপ্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না। তবে তাদের অর্থে বনবিনাশী যে মনোকালচার শুরু হয়েছে তা এখনো চলছে। বিশেষ করে বিদেশি প্রজাতির মনোকালচার প্লান্টেশন একেবারে বন্ধ করা উচিত। পাহাড় ও সমতলে সরকারি বনভূমিতে যেখানে সম্ভব সেখানেই মিশ্রবন করার পরিকল্পনা নেয়া দরকার।

বিদেশি টাকা ও পরামর্শকদের খপ্পরে যেন আমরা না পড়ি তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। বনভুমিতে ভূমিদস্যুরা বাণিজ্যিক চাষাবাদ করছে, বনভূমিকে কৃষি জমিতে পরিণত করছে। এরা প্রভবাশালী, রাজনীতিঘনিষ্ট ও ব্যবসায়ী। এদের রুখবার দায়িত্ব রাষ্ট্র-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। সর্বোপরি বনবিভাগের সময়োপযোগী সংস্কার জরুরি।

বাংলানিউজ: প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংস করে সেখানে সামাজিক বনায়ন কতটা যৌক্তিক?

ফিলিপ গাইন: প্রাকৃতিক বনের জায়গায় সামাজিক বনায়নের যে মডেল তা সঠিক নয় বলে মনে করি। প্রাকৃতিক বনের শত শত প্রজাতি নষ্ট করে সেখানে বিদেশি প্রজাতি দিয়ে বনায়ন করা হয়েছে। সামাজিক বনায়নে অংশীদার হওয়ার কথা এলাকার গরিব মানুষের। বাস্তবে অধিকাংশ অংশীদার এলাকার প্রভাবশালী ও সচ্ছল মানুষ। এটাও খুব অন্যায়।

বাংলানিউজ: বনধ্বংসের ফলে আমরা কী ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি?

ফিলিপ গাইন: বন ধ্বংসের কারণে প্রথমত আমরা প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হারাচ্ছি। বন শুধু বৃক্ষ নয়। এর সঙ্গে মানুষ, বন্যপ্রাণী, হাজারো প্রাণ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একটি বনের বিনাশ মানে এসবকিছুর বিনাশ। প্রকৃতির বিবর্তন বলে, উদ্ভিদ থেকে মানুষসহ সব প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ। সেই বন ধ্বংস করে আমরা আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করছি। এর ফলে আমরা আমাদের বিশেষ করে অরণ্যনির্ভর মানুষের বাঁচার অনেক উৎস ধ্বংস করছি। নষ্ট করছি, হাজার বছরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি, জ্ঞান ও শিক্ষা।

বাংলানিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

ফিলিপ গাইন: এখন যা করছি সেটা নিয়েই বেশি চিন্তা ও ব্যস্ততা। গবেষণা ও সম্পাদনার পাশাপাশি মধুপুরের একটি গ্রামে একখণ্ড জমিতে প্রাকৃতিক বা ইকোলজিকাল চাষাবাদে অংশ নিচ্ছি। কাজটি শুরু করেছি গারো নারীদের নিয়ে। দুই একর জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া চাষাবাদ করে দেখব কী হয়। মধুপুর শালবনের জায়গায় এখন ব্যাপক বাণিজ্যিক কলা, আনারস, আদা, হলুদ ও অন্যান্য অর্থকর ফসলের চাষ হচ্ছে। আর এসবের জন্য অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও হরমোনের ব্যবহার হচ্ছে। এতে মাটি নষ্ট হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিও আছে। ক্ষুদ্র একখণ্ড জমিতে প্রাকৃতিক চাষাবাদের একটি মডেল আমরা দাঁড় করাতে চাই। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক চাষাবাদের কলাকৌশল ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এক বা একাধিক ব্যবহারিক বই লেখারও ইচ্ছে আছে।

এছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি জায়গার প্রাকৃতিক ইতিহাস নিয়ে কিছু কাজ করতে চাই। এরমধ্যে মধুপুর শালবন একটি। মধুপুরের উপর দুই দশকের বেশি সময় ধরে তোলা ছবি সংরক্ষণ করতে চাই এবং একটি বইয়ে মধুপুরের অতীত, বর্তমান, কী হারালাম, কেন হারালাম ইত্যাদি লিখতে চাই যা শিক্ষার্থী, গবেষক ও সাধারণ পাঠকের কাজে আসবে। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য নিয়েও কাজের ইচ্ছে আছে। তবে কতটুকু করতে পারব জানি না। কিছু সময় শিক্ষকতায়ও ব্যয় করি। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে গত বছর দশেক পড়াচ্ছি। সেখানে পরিবেশ ও যোগাযোগ নিয়ে পড়াতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের অবস্থা বুঝতে এবং এসব ব্যাপারে আমাদের করণীয় নিয়ে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছি। এসব ছোটখাটো কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত আছি এবং ভবিষ্যতে ব্যস্ত থাকতে চাই।

বাংলানিউজ: ফিলিপ গাইন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad