ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

‘মানুষমারি’ বিলে সম্ভাবনার দ্বার খুলছে

মিলন রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৪
‘মানুষমারি’ বিলে সম্ভাবনার দ্বার খুলছে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যশোর: শত বছরের পতিত যশোরের মানুষমারি বিলে চাষাবাদের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলতে শুরু করেছে। বিলের ৭৫০ বিঘার বিশাল এলাকা জুড়ে কলমিকচাঁর ঝোপজঙ্গল পরিস্কার করে ধান ও মাছ চাষ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে জেলা প্রশাসন।



বিলপাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে চলছে প্রাক-প্রস্তুতির কাজ। সাড়ে ৭শ’ বিঘার এ বিলটিকে চাষাবাদের যোগ্য করে তোলা গেলে বিলপাড়ের ৮ গ্রামের মানুষেরও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে বলে তারা জানিয়েছেন।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার রায়পুর ও বন্দবিলা ইউনিয়নের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত এ মানুষমারি বিল। ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং দুই কিলোমিটার প্রস্থের বিলটি ৮টি গ্রামকে বেষ্টনি করে রেখেছে।

বিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিলটির বিশাল এলাকা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় কলমিকচার ঝোঁপ। এতই তার বিশালতা যে বিলের এ প্রান্তে দাঁড়ালে ও প্রান্তের কিছুই দৃষ্টিসীমায় আসে না। কলমিকচার এইঝোঁপ জঙ্গল মানুষকে অসহায় করে তুললেও নিরাপদ আবাস হয়ে উঠেছে বিষধর সাপ, জোঁক আর ভয়ঙ্কর ইঁদুরের।

বিলের নামকরণ নিয়েও বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে বিলপাড়ের মানুষের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করেন বিলপাড়ে একসময় ছিল শ্মশানঘাট। মানুষ হত্যা করে সেখানে ফেলে রাখা হতো বলেই এর নাম হয়েছে ‘মানুষমারি’।

অনেকে বলেন, বহু বছর আগে বিশাল জোঁক বিলে মাছ ধরতে যাওয়া একজন কৃষকের কোমরের দুইপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে নাভিতে কামড় বসিয়ে রক্ত চুষে মেরে ফেলে। সেই থেকে বিলের নাম হয়ে যায় মানুষমারি।

বিল পাড়ের দাদপুর গ্রামের শতবর্ষী রহমত গাজী, আজমপুর গ্রামের আতর আলী জানালেন মানুষমারি বিলের দুর্গতির কথা। তাদের মতে, বংশ পরম্পরায় তারা জেনে আসছেন এক সময় ফসলের সমারোহ ছিল এই বিলটিতে। কিন্তু তা কয়েকশ’ বছর আগের কথা। এখানে মাছের প্রাচুর্য বিলপাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল।
কিন্তু অদূরদর্শী মানুষ নিজেদের দুর্গতি নিজেরাই ডেকে আনে। বিলে কলমিকচার ডাল পুতে কৈয়ে জাল, পুটে জাল বেঁধে মাছ ধরতে শুরু করে। সেই ডাল বিল থেকে না উঠানোর ফলে বছরের পর বছর ধরে তা কলমিকচা বন জঙ্গল সৃষ্টি করেছে।

এখন এই জঙ্গল বড় বড় ইঁদুর ও সাপের আবাসস্থল হওয়ায় মানুষ বিলে নামতে পারে না। ব্যক্তি উদ্যোগে কলমিকচার এ ঝোঁপ পরিস্কার করে বিলকে ব্যবহারোপযোগী করা একবারেই অসম্ভব বলে নিশ্চিত হয়েছেন বিলপাড়ের সব মানুষ।

বিল থেকে পানি বের হওয়ার একমাত্র পথ আজমপুর খাল পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানিও বিল থেকে বের হতে পারে না। সামান্য বৃষ্টিতেই ৪-৫ ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। আষাঢ়-শ্রাবণে তা ১০-১২ ফুটে দাঁড়ায়। স্থায়ী এ জলাবদ্ধতা আর কলমিকচার জঙ্গল বিলটির অপার সম্ভাবনাকে গ্রাস করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।

ভদ্রাডাঙ্গা গ্রামের কৃষিজীবী আমজাদ আলী ও মো. মহিউদ্দীন, সেকেন্দারপুরের রবিউল, তেলেধান্যপুরের আলতাফ হোসেন ও কলেজ শিক্ষক গোপীনাথ সরকার জানালেন, মানুষমারি বিলের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এখানে রয়েছে ৭৫০ বিঘা জমি।

স্বাভাবিকভাবে প্রতি বিঘায় ২৫ মন ধান উৎপাদন হলে প্রতিবছর কৃষকের গোলায় উঠবে ১৮ হাজার ৭শ ৫০ মন ধান। ৮শ টাকা প্রতি মন ধানের দাম ধরলে দেড় কোটি টাকার উপকার যাবে তাদের ঘরে। ধান চাষের পাশাপাশি বিলের পুবপাশ উঁচু করে চারদিকে সবজি, একপাশে গরুর খামার ও হাঁস চাষ সম্ভব। বিলের চারপাশে ফলদ, বনজ, ওষুধি গাছ লাগিয়ে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করে জীববৈচিত্র্যও রা করা যায়।

গাইদঘাট কৃষিপ্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের কর্মী কৃষক মো. আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সমবায়ের ভিত্তিতে মানুষমারি বিলকে যশোর জেলার অন্যতম অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা সম্ভব। এজন্য কৃষি বিভাগসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন।

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বিলের পশ্চিমপাড় দিয়ে ২শ ফুট খাল খনন, চারপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পাওয়ার পাম্পের সাহায্যে পানি অপসারণ, বিল শুকিয়ে নিয়ে শেকড়সহ কলমিকচা অপসারণ, বিষধর সাপ ও ইঁদুর নিধন প্রয়োজন।

আর এ কারণে বিলটি আবাদযোগ্য করতে বছরের পর বছর ধরেই সোচ্চার বিল পাড়ের মানুষ। বিলপাড়ের বাসিন্দাদের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে গত ৩ মার্চ যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান একটি কমিটি গঠন করেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের এ কমিটি ইতোমধ্যে বিল এলাকা পরিদর্শন করে মাপজোক সম্পন্ন করেছে। এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই খুব শিগগিরই পরবর্তী পদক্ষেপ গৃহীত হবে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি জানান, বিলের জমি চাষাবাদের আওতায় আনা এবং মাছচাষে উপযোগী করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মানুষমারি বিল বাঁচাও আন্দোলন উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক প্রাক্তন মেম্বর মাসুদুর রহমান জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিশাল এ বিলটি চাষাবাদের যোগ্য করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের টিম বিল পরিদর্শন ও পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করেছে। অচিরেই এ কাজ বাস্তবায়ন শুরু হবে বলেও আশাবাদ তার।

রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুর রশীদ স্বপন বাংলানিউজকে জানান, বিলটি চাষাবাদের আওতায় আনা গেলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। এ জন্য গ্রামবাসীর চাওয়ার সাথে একাত্ম হয়ে তিনি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি রেজুলেশনও করেছেন।

সেটি উপজেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বিল পরিস্কারের জন্য তার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা বরাদ্দেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

বিল সমস্যার সমাধানে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিওর সমন্বয়ে গড়া বিল ক্যাম্পেইন গ্রুপ। এই গ্রুপের অন্যতম উলাসী সৃজনী সংঘ বিলপাড়ের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ হতেও ভূমিকা ররেছে।

বিল ক্যাম্পেইন গ্রুপের সদস্য সচিবের দায়িত্বে আছেন উলাসী সৃজনী সংঘের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার আজিজুল হক মনি।

তিনি জানান, মানুষমারি বিলকে এভাবে অনন্তকাল পতিত ফেলে রাখার সুযোগ নেই। বিলকে আবাদযোগ্য করার জন্য যা যা করা দরকার তা করতে হবে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে বিলটি আবাদি করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

দ্রুতই তা বাস্তবায়ন হবে বলে আশাবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, জাতীয়ভাবে খাদ্য নিরাপত্তায় এই বিল বিশাল ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯ ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।