ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

ঢাকার বৃক্ষশোভা

মোকারম হোসেন, ন্যাচার অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২২ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৪
ঢাকার বৃক্ষশোভা

ঢাকা: ঢাকার নিসর্গশোভা নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমেই মোঘল ও ইংরেজ শাসনামলের কথা অনিবার্যভাবে উঠে আসে। তখন ভারতবর্ষের বিখ্যাত শহরগুলোতে মূলত প্রাসাদকেন্দ্রিক উদ্যান কিংবা উদ্যানকেন্দ্রিক প্রাসাদের রেওয়াজ ছিল।

মুক্ত অঞ্চলে উদ্যান তৈরির দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।

ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় ‘রমনা গ্রিন’ নামে নৈসর্গিক শোভা বর্ধনের যে গোড়াপত্তন হয় তারই ধারাবাহিকতা বর্তমান রমনা পার্ক। শুধু তাই নয়, তখন ঢাকায় নিযুক্ত লন্ডনের কিউ গার্ডেনের উদ্যোক্তা রবার্ট লুই প্রাউডলক পৃথিবীর উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে যেসব বৃক্ষপ্রজাতি ঢাকায় এনেছেন তা থেকেই আমাদের নিসর্গ শোভা বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি বৈচিত্র্যময়ও হয়ে উঠেছে।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমান্বয়ে ঢাকার আয়তন বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ইট-সুড়কির জঞ্জাল। কিন্তু মানুষ এবং অবকাঠামোর তুলনায় নৈসর্গিক সৌন্দর্য বাড়েনি। বতর্মান ঢাকা মূলত রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেন্দ্রিক নিসর্গ শোভায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বড় জোর তার সঙ্গে ধানমণ্ডি, উত্তরা ও গুলশান-বনানীর কিছু অংশকে যুক্ত করা যেতে পারে।

তবে ঢাকার মূল কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে রমনা পার্ক আমাদের কাছে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রমনাকে বলা হয় ঢাকার ফুসফুস। এই নগরীর সিংহভাগ মানুষকে প্রতিনিয়ত বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ করছে পার্কটি। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন অজস্র মানুষ বিনোদন ও শরীরচর্চার প্রয়োজনেও এ পার্কে আসেন। পার্ক লাগোয়া হেয়ার রোড এবং বেইলি রোডও বিচিত্র বৃক্ষরাজিতে সুসজ্জিত। আছে অনেক শতবর্ষী দুর্লভ গাছপালা। সারা বছরই নান্দনিক পুষ্প-প্রাচুর্যে বর্ণাঢ্য থাকে এ পার্ক।

ছায়াঢাকা হেয়ার রোডে আছে শতবর্ষী দুর্লভ পাদাউক বৃক্ষের বীথি। গ্রীষ্মের কোনো একদিন অপূর্ব সোনালি রঙের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছ। পরের দিন গাছতলায় শুধু ঝরাফুলের রোদন। তার পাশেই আছে একসার সুদৃশ্য কুসুম গাছ। বসন্তে টকটকে লাল কচিপাতাগুলো বর্ণাঢ্য আয়োজনে মাতিয়ে রাখে গোটা এলাকা। পাতার উজ্জ্বল রং কৃষ্ণচূড়ার মতো অনেক দূর থেকেই আমাদের নজর কাড়ে।

আমাদের নিসর্গ শোভার প্রাণকেন্দ্র এ পার্কের অন্যান্য দুর্লভ সংগ্রহের মধ্যে আরও আছে- পলাশ, পীতপাটলা, কাউয়াতুতি, আগর, জ্যাকারান্ডা, তমাল, বাওবাব, গ্লিরিসিডিয়া, কর্পুর, স্কারলেট কর্ডিয়া, জহুরিচাঁপা, লালসোনাইল, মাধবী, মালতী, আফ্রিকান টিউলিপ, অশোক, পাখিফুল, কফি, উদয়পদ্ম, সহস্রবেলী, গোল্ডেন শাওয়ার, পালাম, ঝুমকো, লতাপারুল, স্থলপদ্ম, মহুয়া, কুর্চি, বনআসরা, চন্দন, মাকড়িশাল, দুলিচাঁপা, কনকচাঁপা, মণিমালা ইত্যাদি।

তাছাড়া একটি সুন্দর অশোক বীথিও আছে পূর্ব পাশে। বসন্তে সেখানে লাল-হলুদ মেশানো ফুল ফোটে। মরু অঞ্চলের বাওবাব গাছ আছে মাত্র দুটি ও বুদ্ধ নারকেল একটি। বকুল গাছের একটি ছায়া সুনিবিড় বীথি আছে পূব পাশে। সেখানে বকুলের মধুগন্ধ ভেসে বেড়ায় সারা বছর। নার্সারির পাশে আছে বুনো আমের একটি পুরনো বীথি।

রমনা থেকে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দৃষ্টি ফেরানো যাক। পুরো এলাকাটি বিচিত্র গাছপালায় ছায়াঢাকা ও মায়াময়। কার্জন হল প্রাঙ্গণের উদ্যানটি অত্যন্ত সুসজ্জিত। উদ্যানের দীর্ঘ সবুজ ঘাসের পটভূমিতে মাথামুড়ানো সারিবদ্ধ নাগেশ্বর সত্যিই অপূর্ব। হালে লাগানো হয়েছে সুদৃশ্য পাতার বেশ কিছু সিলভার ওক। চোখে পড়ার মতো আর আছে অসংখ্য ঝোঁপালো গন্ধরাজ। অবশ্য পূর্ব-উত্তর প্রান্তের উদ্ভিদ উদ্যানটিও বেশ সমৃদ্ধ। টিএসসি সড়কদ্বীপ লাগোয়া পথের ধারে সুউচ্চ বুদ্ধ নারকেল ও বেরিয়া অনেক দূর থেকেই আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। এখান থেকে চারদিকে প্রলম্বিত পথগুলো অসংখ্য সুউচ্চ গাছপালায় ছায়াঢাকা। গ্রীষ্মে রোকেয়া হলের সামনের পথটি জারুলের উচ্ছ্বাসে প্রাণোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আবার অনতিদূরেই থাকে বসন্তের গ্লিরিসিডিয়া।  

গ্রীষ্মে সবচেয়ে বর্ণিল পুষ্পপ্রাচুর্যে ভরে ওঠে শেরেবাংলা নগর এলাকা। চন্দ্রিমা উদ্যান লাগোয়া ক্রিসেন্ট লেকের ধারে সুউচ্চ গাছে গাছে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফোটে। গ্রীষ্মের পুরোটা সময় জুড়ে কৃষ্ণচূড়ার মনমাতানো রং আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পথের একপাশে ফোটে অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত ফুল সোনালু বা সোনাইল। ঝাড়-লণ্ঠনের মতো ঝুলে থাকা সোনালি রঙের এ ফুলগুলো গ্রীষ্মের প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে রাখে। আবার সংসদ ভবনের খেঁজুর বাগান থেকে একেবারে চন্দ্রিমা উদ্যান পর্যন্ত সোনালি রঙের কনকচূড়ার দীর্ঘ বীথি গ্রীষ্মের পুষ্পোদ্যানকে মাতিয়ে রাখে।

জানা মতে, ঢাকায় কৃষ্ণচূড়া, কণকচূড়া আর সোনালুর এমন দীর্ঘ বীথি আর দ্বিতীয়টি নেই।

ঢাকায় নিসর্গ-সৌন্দর্যের সন্ধানে আমরা ধানমণ্ডি, উত্তরা ও গুলশান-বনানী আবাসিক এলাকার পাশাপাশি জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান এবং বলধা গার্ডেনেও ছুটে যাই। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আছে ফল বাগান, গজারি বন, বিদেশি গাছপালা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যান। তাতে আছে-সিলভার ওক, অয়েলপাম, অ্যারিকাপাম, থাইল্যান্ডের রাম্বুটান, ইত্যাদি।

এ উদ্যানের পূর্ব পাশে আছে ক্যাকটাসের ঘরসহ আরো অনেক গাছ। মরু অঞ্চলের গাছ জন্মানোর জন্য আছে নেট হাউস। তার পাশেই চন্দন গাছের প্রদর্শনী প্লট। ভেষজ বাগানের কাছে আছে পামবাগান। পূর্ব দিকে আছে গর্জন ও বাঁশপাতা গাছের দু’টি প্রদর্শনী প্লট। বাঁশপাতা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এটি বাংলাদেশে একমাত্র নরমকাঠের পাইন জাতীয় গাছ।

শাপলা পুকুরে ফোটে অসংখ্য লাল শাপলা। নার্সারির পাশের ছোট্ট পুকুরটিতে আছে দুর্লভ হলুদ শাপলা। প্রকৃতিপ্রেমীরা সারাদিন এ উদ্যানের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দিতে পারেন।

বলধা গার্ডেনের সাইকি ও সিবিলি অংশ মিলিয়ে সর্বমোট ৮৭ পরিবারের ৭২০ প্রজাতির ১৭ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে। এসব দুর্লভ বৃক্ষের সন্ধানে প্রতিদিন অসংখ্য নিসর্গপ্রেমী সেখানে ভিড় করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৫২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।