ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

মাছের মৌসুম কবে আসবে, অপেক্ষা সবার

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০২ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৪
মাছের মৌসুম কবে আসবে, অপেক্ষা সবার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী থেকে:  রাজনীতির অবরোধের ঢেউ এখানকার মানুষকে স্পর্শ করে না। কিন্তু সমুদ্র আর নদীর অবরোধের প্রভাব পড়ে সবার ওপরে।

মাছ ধরায় অবরোধ আরোপের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ জনপদ নিস্প্রাণ হয়ে পড়ে। দিনরাত জেগে থাকা জনপদ ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যবসায় ভাটা পড়ে। মানুষের হাতের টাকা ফুরিয়ে যায়। তাইতো মাছের মৌসুমের জন্যেই দিন গোনেন সবাই।

সমুদ্র উপকূলে জেগে থাকা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের চিত্র এমনই। শহরের আলো বাতাস থেকে বহু দূরে প্রকৃতির কোলে জেগে থাকা এ জনপদের মানুষের জীবিকায় থাকে নানামুখী সংকট। তাই তো মাছের মৌসুমে মাছ ধরা, মাছ না পেলে অন্য পেশায় ফেরা। এলাকায় কাজ না থাকলে শহরের দিকে ছুটে চলা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভয়াল বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর মোহনায় চরমোন্তাজের ঘাটে মাছের ট্রলারের সংখ্যা একেবারেই কম। নিস্প্রাণ মাছ বাজার। শূন্য পড়ে আছে মাছের আড়তের গদি। মাছ ব্যবসায়ীরা ফিরেছেন অন্য ব্যবসায়। চরমোন্তাজের প্রাণকেন্দ্র স্লুইজ বাজারে দোকানপাটের সংখ্যাও অনেক কম। চা-পানের দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সবখানেই লোক সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

বউবাজার, নয়ার চর, বাইলাবুনিয়া, দাঁড়ভাঙ্গা, চর বেস্টিন ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পায়, বহু জেলে কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে মাছধরা পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যোগ দিয়ে কোনোমতে অভাবের মৌসুমটা পার করার চেষ্টা করছেন। কেউ আবার অন্য কোনো কাজ না পেয়ে এলাকা ছেড়ে শহরে ছুটেছেন।

বউ বাজারের চা-দোকানদার আনোয়ার হোসেন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় নতুন এ পেশায় রোজগারের চেষ্টা করছেন। তার মাছ ধরার নৌকাটি তিনি মেরামতের জন্য উঠিয়েছেন। একই সঙ্গে জাল মেরামতের কাজ চলছে।

বউ বাজার, নয়ার বাজারে আরও বেশকিছু জেলের সঙ্গে দেখা হলো, যারা নৌকা-জাল মেরামতের কাজে ব্যস্ত। অনেকে গচ্ছিত সঞ্চয় ভেঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন। আবার অনেকে ধার-দেনা করে কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন।

চরমোন্তাজ স্লুইজ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, মাছের মৌসুম শুরু হয় বৈশাখ মাস থেকে। টানা আশ্বিন পর্যন্ত পুরোদমে ছয়মাস মাছ ধরা চলে। আর এ মাছ ধরাকে ঘিরে চলে নানা আয়োজন। মৌসুমের শুরুতে বিভিন্ন এলাকা থেকে জেলে-ব্যবসায়ী-আড়তদারেরা এসে ভিড় করেন এখানে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। এক মৌসুম ভালো রোজগারের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে জেলেরা এসে চরমোন্তাজের ঘাটে ট্রলার নোঙর করেন। মৌসুম ঘিরে কেউবা মালিকের সঙ্গে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হয়। সবারই লক্ষ্য মাছের মৌসুমে কিছু বাড়তি রোজগার।

চরমোন্তাজ বাজার কমিটির সভাপতি মো. হানিফ বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য মাছ আহরণের ওপর নির্ভরশীল। সাগর ও নদীতে মাছ পাওয়া গেলে ব্যবসা জমজমাট হয়। কিন্তু মাছ ধরা বন্ধ থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য ঝিমিয়ে পড়ে।

স্লুইজ বাজারের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। মাছ পাওয়া-না পাওয়ার ওপর তাদের জীবন চলে। এখন মাছ ধরা পড়ছে না বলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। এ সময়টাতে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া মানুষ কিছুই কেনেন না।

সরেজমিনে ঘুরে পাওয়া তথ্য বলছে, চরমোন্তাজের মানুষের জীবিকা মাছ ধরার ওপরই নির্ভরশীল। মাছের মৌসুমে পান দোকানদার থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ীরাই বাড়তি রোজগার করেন। সে জন্যে তাদের প্রস্তুতিও থাকে। আর রোজগারের সে সময়টি হচ্ছে বর্ষাকাল। এ সময়ে যেখানে মানুষের কাজে ভাটা পড়ে, সেখানে চরমোন্তাজ জেগে ওঠে পুরোদমে। মানুষের হাতে টাকার অভাব থাকে না। ঘরের বাড়তি কেনাকাটার চিন্তাও এখানকার লোকজন এ সময়েই করে থাকেন।        

চরমোন্তাজের বাসিন্দারা দাবি তুলেছেন, মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে এখানে একটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। সড়ক যোগাযোগ আর বিদ্যুতের সুবিধা দেওয়া হলে সমুদ্র-নদীর সম্পদ ঘিরেই এখানে আরও অনেক শিল্প গড়ে উঠতে পারে। তখন চরমোন্তাজ সারা মৌসুমের জন্যই জমজমাট হয়ে উঠবে। মাছ ধরা ছাড়াও মানুষের হাতে থাকবে অনেক কাজ।  
 
স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে, সমুদ্রের নোনা জল বিধৌত চরমোন্তাজের পত্তন ঘটে ১৯৪২ সালের দিকে। ১৯৯১ সালে এখানকার ওয়াপদা বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়। সে সময় চরমোন্তাজ ছিল রাঙ্গাবালী উপজেলার অধীনে রাঙ্গাবালী ইউনিয়নের সামুদাবাদ ওয়ার্ডের অংশ। ১৯৯২ সালে এটি পৃথক ইউনিয়নে রূপান্তরিত হয়। তখন এ ইউনিয়নে ভোটার ছিলেন মাত্র সাড়ে চার হাজার। আর বর্তমানে এখানে ভোটার রয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার।   

বাংলাদেশ সময়: ০১০২ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।