ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

জীব-বৈচিত্র্যের আধার খাদিম জাতীয় উদ্যান

সাব্বির আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫০ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৪
জীব-বৈচিত্র্যের আধার খাদিম জাতীয় উদ্যান ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিলেট: দু’পাশে ঝিঝি পোকার অনবরত ডাকাডাকি। বিরল পাখির প্রণয় সংগীত আর অচেনা পাখ-পাখালির শব্দে মুখর গহীন জঙ্গল।

পাহাড় ভেদ করে জঙ্গলে রয়েছে প্রকৃতির মায়াবী পরিবেশ।

বনের দু’দিকে এক ঘণ্টা ও দুই ঘণ্টার দুটি ওয়াকিং ট্রেইলে পর্যটক হারিয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশের জীব-বৈচিত্রের অন্যতম আধার সিলেটের খাদিম নগর জাতীয় উদ্যানে। কিন্তু দেশের ও খোদ সিলেটের অনেকের জানা নেই এই উদ্যানের কথা!

একই সঙ্গে চা-বাগান, গহীন জঙ্গলের প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা আর ঝরণা ধারা সব আছে এই উদ্যানে। দেশে বিরল প্রজাতীর নানা জীবজন্তুর আশ্রয়স্থল এই উদ্যানের আয়তন ৬৭৮.৮০ হেক্টর (১৬৭৬.৭৩ একর)। এতে রয়েছে ২১৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির উভয়চর, ৯ প্রজাতির সরিসৃপ, ২৮ প্রজাতির পাখি ও ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।

সিলেট শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে খাদিমনগর ইউনিয়ন ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।

বর্ষাকালে ঝোপঝাড় ও বনের গাছগাছালি নিবিড় হওয়ায় সূর্যের আলো তেমন পৌঁছায় না। হাঁটতে হাঁটতে চারিদিক তাকালে চোখে পড়ে ট্রি ফার্ন। ৩০ ফুট উঁচু শতবর্ষী ট্রি ফার্ন পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের উদ্ভিদের মধ্যে একটি।

এই বনের ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম, ফুল-ফল বৈচিত্র্যপূর্ণ। কদম, বেলিসহ অসংখ্য নাম না-জানা বুনো ফুলের ফটো ওঠানো হলো।

উদ্যানে দিনরাত বিচরণ করে করছে হনুমান, বানর, দোয়েল, ময়না, শ্যামা, কাক, কোকিল, টিয়া, কাঠঠোকরা, মাছরাঙ্গা, চিল, ঘুঘু, বক, টুনটুনি, চড়ুই, বুলবুলি, বনমোরগ, মথুরা, শালিক, বানর, হনুমান, শিয়াল, বনবিড়াল, বেজি, কাঠবিড়াল, ইঁদুর, খরগোস, মেছো বাঘ, বিভিন্ন ধরনের সাপ যেমন- অজগর, দারাইশ, উলুপুড়া, চন্দ বুড়া, ইত্যাদি বিষধর সাপ।

খাদিম জাতীয় উদ্যানের বেশিরভাগ ভূমিতে রয়েছে মূল্যবান বৃক্ষরাজি। সেগুন, ঢাকি জাম, গর্জন, চম্পা ফুল, চিকরাশি, চাপালিশ, মেহগিনি, শিমুল, চন্দন, জারুল, আম, জাম, কাউ, লটকন, বন বড়ই, জাওয়া, কাইমূলা, গুল্লি, পিতরাজ, বট, আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, মান্দা, পারুয়া, মিনজিরি, অর্জুন, একাশিয়া, বাঁশ (জাইবাশ, বেতুয়া বাঁশ, পেঁচা বাঁশ, পারুয়া বাঁশ) এবং বেত (তাল্লাবেত, জালিবেত) ইত্যাদি। গাছপালা, তরুলতা, বাঁশ-বেত পরিবেষ্টিত খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে জীব-বৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে রয়েছে ৪০-৫৫ ফুট উঁচু মূল্যবান সেগুন গাছ।

বন বিভাগ জানায়, উদ্যানে প্রায় ২১৭ প্রজাতির গাছ এবং ৮৩ প্রজাতির প্রাণি রয়েছে। সন্তর্পণে বন হাঁটলে পেয়ে যেতে পারেন, অজগর সাপ, বিরলপ্রজাতির মুখপোড় হুনুমান। আর বানরের দল ঘুরে ফিরে সামনে এসে পড়বেই।
 
শুধু বন্যপ্রাণী আর জীব-বৈচিত্র্যই নয় খাদিম নগর জাতীয় উদ্যান এখন দেশের জীব-বৈচিত্র গবেষকদের অন্যতম শিক্ষালয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছুটে আসছেন অভয়ারণ্যের ভীড়ে নানা প্রজাতির প্রাণীবৈত্রির সন্ধানে।

বছর দু’য়েক আগে খাদিম নগর জাতীয় উদ্যানে গহীন অরণ্যে নতুন প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাজী আসমত ও একই বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ আলী হাওলাদার এটি সনাক্ত করেন।

তবে তারা জানান, এর আগে এ প্রজাতির ব্যাঙ বিশ্বের কয়েকটি দেশে সনাক্ত হলেও বাংলাদেশে পাওয়া গেল এই প্রথম। এর আগে বাংলাদেশে ৩৭ প্রজাতির ব্যাঙের রেকর্ড রয়েছে। এখন এটিসহ ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৮-এ।

খাদিমনগরের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা শিক্ষার্থীদের তথ্যে জানা গেছে, খাদিম উদ্যানে  ১৩ প্রজাতির ব্যাঙ সাধারণত চোখে পড়ে। এর মধ্যে একটি প্রজাতি রয়েছে যে ব্যাঙ্গ বাংলাদেশের শুধু চট্রগ্রাম ও সিলেটে দেখতে পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, নতুন প্রজাতির ব্যঙ্গটি বিশ্বের মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং  থাইল্যান্ডে দেখতে পাওয়া যায়।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে খাদিম নগর জাতীয় উদ্যান হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষিত হয়েছে। সিলেটের বনবিভাগ এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। রেকর্ডপত্রে দেখা যায় ১৯৫১-৫২ সাল থেকেই এখানে বনের অস্তিত্ব রয়েছে।

১৯৫৭ সালে এই বনকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা অনুযায়ী উষ্ণমণ্ডলীয় চিরসবুজ এই বন দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্ম, বন্য প্রাণী, পাখিদের অভয়াশ্রম।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকার সভাপতি রাহুল দাশ তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গাছ ও বন্যপ্রাণী পাচারসহ নানা কারণে আজ খাদিমনগর উদ্যানের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। সংরক্ষিত বনের সঠিক রক্ষণাবেক্ষন, জনসাধারণের অবাধ যাতায়াত বন্ধ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করলে এই উদ্যান সিলেট তথা সমগ্র বাংলাদেশের জীব-বৈচিত্র্যের হটস্পট হিসেবে নিজের স্থান সুদৃঢ় করবে।

বনের রোমঞ্চকর সৌন্দর্য নিতে প্রায় ওয়াকিং ট্রেইল ধরে চলেন রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আহমদ সালিম সারওয়ার। তিনি বলেন, বুনোপথের হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়বে স্বচ্ছ পানির ছড়া। ছড়ার শীতল পানিতে পা ভিজিয়ে নিলে চাঙা করে তুলবে সামনের পথ পাড়ি দিতে। সিলেটের পর্যটন বিকাশে বনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সারওয়ার বলেন, তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে যাতে বন্য প্রাণীকে কেউ উত্যক্ত না করেন। বন্যপ্রাণীকে তাদের মতো চলাফেরা করতে দিতে হবে। তবেই জীববৈচিত্র্য ঠিকে থাকবে।

বনের অবস্থান: খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের পূর্বে ছড়াগাং চা বাগান, জালালাবাদ সেনানিবাস এবং হবিবনগর চা বাগান, পশ্চিমে বুরজান চা বাগান, কালাগুল চা বাগান, উত্তরে গুলনী চা বাগান এবং দক্ষিণে খাদিম চা বাগান।

সিলেটের পূর্বদিকে জাফলং যাওয়ার পথে নগরী থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বনের অবস্থান। সিলেট বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলেট উত্তর রেঞ্জ-১ এবং খাদিমনগর বন বীটের আওতাভুক্ত।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।