ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

উপকূল থেকে উপকূল

জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪
জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে।

হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গন্ডায়। শুণ্য হাতেই ফিরতে হয় ঘরে। দিন আনা দিন খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না। জীবনভর জেলে পেশায় থেকেও এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারে না। উপকূল ঘুরে জেলে জীবনের এইসব অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। ‘জেলেজীবনে দু:খগাঁথা’ শীর্ষক সাত পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব
    

উপকূল অঞ্চল ঘুরে এসে: যে হাতে থাকার কথা ছিল বই, সে হাতে ইলিশের জাল। যে হাতে রঙ-পেন্সিলে ছবি আঁকার কথা ছিল, সে হাতে বইতে হচ্ছে মাছের বোঝা। যে চোখ স্বপ্ন দেখত এক সোনালী আগামীর, সে চোখ শুধুই রোজগারের পথ খুঁজে বেড়ায়। শৈশব-কৈশোরের উল্লাস-উচ্ছ্বাসের আনন্দ ওদের কাছে ম্লান হয়ে যায়। মাত্র ৭-৮ বছর বয়সে মাছ ধরতে নামতে হয়। আর এভাইে জেলে পরিবারের শিশুরা ষোলতেই হয়ে ওঠে দক্ষ মাঝি।

উপকূলের জেলে পরিবারের শিশুদের অবস্থা এমনটাই। ভোলার দৌলতখান, ইলিশা, লক্ষীপুরের রামগতি, কমলনগর, হাতিয়ার বুড়িরচর, কোড়ালিয়া, কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী, গাঙচিলের বিভিন্ন এলাকায় জেলে পল্লী ঘুরে স্কুল পড়–য়া ছেলেমেয়েদের খুব একটা দেখা মেলেনি। কেউ কেউ হয়তো প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, এরপর কাজে নামতে হয়েছে। আর সে কাজটা হচ্ছে মাছ ধরা।

ভর দুপুরে ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর থেকে বেড়িবাঁধ ধরে চৌকিঘাট মাছ আড়‍ত এলাকার দিকে যাওয়ার পথে বহু শিশু-কিশোরের সঙ্গে দেখা মেলে। সবচেয়ে ছোট যে ছেলেটি মাছ ধরতে যায়, তার বয়স ৭ বছর। দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে অনেক আগেই। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কাজ ফেলে এসব শিশুরা এসেছে দুপুরের খাবার খেতে।



একজন শহিদ। মো. ইদ্রিসের ছেলে। বয়স ১৩ বছর। সাত বছর ধরে মাছ ধরে। অর্থাৎ মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই শহিদ তার বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যাওয়া শুরু করেছে। মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। জীবিকার টানে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বড় ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেছে। এই বয়সে শহিদকে তিন জনের সংসার চালাতে হয়। লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকলেও শহিদের সে সুযোগ নেই।

মো. বাবুল মিয়ার ছেলে ইব্রাহিম। বয়স মাত্র ৯ বছর। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে ইব্রাহিম সবার বড়। তাই রোজগারের ভার তার মাথায়। মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও অভাব অনটনের কারণে তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দুই বছর ধরে পুরোপুরি মাছ ধরা পেশায়। ইব্রাহিমসহ আরও দুই শিশু একটি জেলে নৌকায় মাছ ধরে। দিন শেষে মাছ বিক্রি করে যা পাওয়া যায়, তা তিনজনে ভাগ করে নেয়।

নূরুল ইসলামের ছেলে মিলন। বয়স ১৫ বছর। এই বয়সেই সে দক্ষ মাঝি। তিন ভাইয়ের মধ্যে একজন মাছের আড়তে কাজ করে, একজন মাছের মোকামে আর মিলন নদীতে মাছ ধরে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল মিলন। এখনও রোজগারে নামতে হয়েছে বলে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে।



নোয়াখালীর হাতিয়ার কোড়ালিয়া গ্রাম। মেঘনার তীর ধরে বহু জেলে পরিবারের বসবাস। মেঘনায় মাছ ধরেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। শিশুকাল থেকেই ছেলেদের মাছ ধরতে পাঠায়। মেঘনা থেকে উঠে আসা কোড়ালিয়ার কাটাখালী খালের মোহনায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকটি ছোট সাইজের মাছ ধরার নৌকা এসে ভিড়লো ঘাটে। নৌকায় যারা আছে, সবাই শিশু।

কোড়ালিয়া জেলে পল্লীর অভিভাবক হরিপদ চন্দ্র বলেন, আমরা যেমন বাপদাদার পেশায় থেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছি, আমাদের ছেলেদেরও এই কাজই করতে হবে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ আমরা। মাছ না পেলে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নদীতে না গেলে তো জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। লেখাপড়ার করানোর সামর্থ্য নেই।

হাতিয়ার বুড়িরচর, জাহাজমারা, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন ঘুরে স্কুলে না যাওয়া বহু শিশু কিশোরের দেখা মেলে। স্কুলে যাচ্ছে না বলে কারও কোন অবসর নেই। অনেকেই পৈত্রিক পেশার সূত্র ধরে মাছ ধরছে। অনেকে আবার সংসারের কাজে সহায়তা হিসাবে কাঠ কুড়ানো, মাটিকাটাসহ অন্যান্য কাজে যুক্ত হচ্ছে।
বুড়িরচর ইউনিয়নের ইউপি মেম্বার নিজামউদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, একদিকে প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। অন্যদিকে অভিভাবকদের মধ্যে নেই সচেতনতা। এর ওপর পরিবারে আর্থিক অনটন তো আছেই। এইসব কারণেই জেলে পরিবারের শিশুরা স্কুলে না গিয়ে কাজে যায়।      
     
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।