ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

উল্লুকের মুল্লুকে

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন; ছবি: নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪
উল্লুকের মুল্লুকে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লাউয়াছড়া, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: অগোছালো চলাফেরা, মূর্খামি আর বন-বাদাড়ে গাছের মাথায় ঝুললে মানুষকে ‘উল্লুক’ বলে গালি দিতে আমরা ভুলি না। লাউয়াছড়ার বন-জঙ্গল তিনদিন চষে বেড়িয়ে শুধু একটি কথাই আমরা বলেছি, ‘উল্লুকের মুল্লুকে এসে আমরা তো সত্যি ‘উল্লুক’ হয়ে গেলাম।

এত অভিধার সঙ্গে নিরীহ এ প্রাণীটির আদৌ মিল কতটুকু তা বোঝার মতো সুযোগ অবশ্য আমাদের খুব বেশি হয়নি। তবে অভিজ্ঞতা হয়েছে কোথায়, কীভাবে ছুটলে দেখা হবে উল্লুকের। অনেক ধারণাও প্রমাণিত হয়েছে মিথ্যা। চারদিনের শ্রীমঙ্গল সফরের তিনদিন কেটেছে উল্লুকের পিছে ছুটে। অবশ্য এতে লোকসান খুব একটা হয়নি। প্রথমে উল্লুক মনে করে চশমা পরা বানর দেখে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, তারপর একে একে মুখপোড়া হনুমান, কয়েক প্রজাতির বানর, কালো কাঠবিড়াল, ধনেশ পাখি দেখা। সে গল্প আরেকদিন।

Ulluk_01

আগের দুদিন ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় দিন শীতের কুয়শা ঠেলে লাউয়াছড়া গেলাম বেশ সকালে। যেভাবেই হোক দেখা চাই কাঙ্ক্ষিত উল্লুক। প্রাণীটিকে বলা যায় লাউয়াছড়া বনের প্রধান পরিচয়। সমস্যা হলো খুব সকাল আর কালেভদ্রে বিকেলে দেখা মেলে উল্লুকের। তিনদিনে একেকজন দিয়েছেন একেক পরামর্শ। কোনোটিতে কাজ হয়নি। শেষদিন নতুন গাইড নিয়ে ছুটলাম। অন্য বিটে। বিট কর্মকর্তা বললেন জানকিছড়া বিটে যেতে। বেশ খানিকটা বন-জঙ্গল ঠেলে অনেকটা বিপথে অত্যন্ত সন্তর্পনে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে পাঁচ হাত দূর দিয়ে হরিণের ভুঁ-দৌড় আর বন্য শূকরের বাসা ছাড়া কিছুই পেলাম না। বনের ভেতরের ছড়া (এখন শুধু বালি আর অন্ধকার, জল নেই) দিয়ে আবার হাঁটা।

Ulluk_02

কিছুতেই শোনা গেলো না উল্লুকের ডাক। না ডাকলে বোঝারও উপায় নেই তাদের অবস্থান। কারণ গাছের মগডাল তাদের প্রিয় স্থান। আরও কিছুটা হেঁটে পৌঁছুলাম জানকিছড়ায় বন অফিসের কাছে। সেখানে গিয়ে শুনলাম একটু আগেই নাকি তিনটি উল্লুক ছিল। একটি আবার বাচ্চা। পাশে জিজ্ঞেস করে জানলাম আজ আর দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। একরাশ হতাশা নিয়ে আরও ঘণ্টাখানেক ঘুরলাম। তবু দেখা পেলাম না।


আরও এক কিলোমিটার এগিয়ে ক্লান্তপ্রাণে বসলাম রাস্তার পাশের একটি দোকানে। ফিরে যাব শ্রীমঙ্গলে। এবার আর দেখা হলো না উল্লুক। হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন আপনারা এখনো আছেন। একটু আগে তো সকালে যেখানে ছিল সেখানে আবার এসেছির আপনারা যাওয়ার ঠিক পরপরই। তবে সবসময় আসেন এমন। বললেন এক ভদ্রলোক। সঙ্গে সঙ্গে নূর বাইকে একজনকে নিয়ে ছুটলেন। আমিও কোনোভাবে স্থির থাকতে পারলাম না। ছুটলাম গাইডের সাইকেলটি নিয়ে।

Ulluk_03

 

আমি যখন পৌঁছুলাম তখন ব্যর্থ মনোরথে টিলা থেকে নামছেন নূর। হতাশ না হয়ে বললাম, আমি একবার দেখে আসি। বলে উঠে গেলাম টিলায়। বেশ খাঁড়া জায়গাটি। খুব আস্তে আস্তে তাক‍াতে থাকলাম সামনের চাপালিশ গাছটির মাথায়। প্রায় পাঁচ মিনিট চুপচাপ। হঠাৎ যেন একটি ডাল নড়ে উঠলো। কেঁপে উঠলাম আমিও। তারপর পাতার আড়াল ঠেলে দেখা পেলাম আমাদের আরাধ্য প্রাণীটির। দূর থেকে ইশারায় ডাকলাম নূরকে। আলোর বিপরীতে থাকায় ছবি নিতে এবং দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। তাতে আবার খাঁড়া জায়গা।

Ulluk_40


প্রথমে একটি মনে হলেও পরে দেখা গেলো ধূসর রঙের উল্লুকটির কোলে একটি শাবক। আরও খুশি হয়ে গেলাম। উত্তেজনা বেড়ে গেলো আরও। কিছুক্ষণ পরই তারা টের পেলো আমাদের অবস্থান। ব্যস, অমনি ছুটলো আরেক গাছে। এসময় হঠাৎ বেরুলো আরেকটি কালো উল্লুক। কিছুতেই দেখা গেলো না তার মুখ। লম্বা হাত দুটি দিয়ে ডাল-পালা বেয়ে চলে গেলো মুহূর্তে। তবু স্বস্তির নিশ্বাস আমাদের। সকালে ছ‍াড়া দেখা যায় না, না ডাকলে বোঝা যায় না অবস্থান- সবই প্রমাণিত হলো মিথ্যা। ধৈর্য আর ইচ্ছেশক্তি থাকলে আসলে সব সম্ভব না হলেও অনেক কিছুই হয়তো সম্ভব। প্রমাণিত হলো সেটাই। তবে নামার সময় লতা ছিঁড়ে ক্যামেরাসহ নূরের পড়ে যাওয়ায় যাত্রার শেষটা খুব ভালো হয়নি আমাদের। উল্লুক সত্যি আমাদের ‘উল্লুক’ বানালো শেষে।

Ulluk_05


দেশের বরেণ্য বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুল খান উল্লুক বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, উল্লুককে বিশ্বব্যাপী 'বিপন্ন প্রাণী' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি বিপন্ন তালিকাভুক্ত। খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য উল্লুক পুরোপুরি বৃক্ষের ওপর নির্ভরশীল। অবাধে বড় বড় গাছপালাসহ বন ধ্বংসের কারণে একদিকে যেমন দেখা দিচ্ছে খাদ্যাভাব, তেমনি উল্লুক হারাচ্ছে তাদের উপযুক্ত আশ্রয়স্থল। উল্লুক গাছে-গাছে ডালে-ডালে ঘুরে বেড়ায়। এরা নিচে আসে না। চাপালিশ, ডুমুর, বনজামসহ নানা ধরনের ফল, কচি লতাগুল্ম এবং অল্পসংখ্যক পোকামাকড় খেয়ে এরা জীবনধারণ করে।  

ulluk_07


তিনি আরও বলেন, উল্লুকের ইংরেজি নাম Hoolock Gibbon এব‍ং বৈজ্ঞানিক নাম Hylobates hoolock। এর অপর একটি নাম হলো ‌‌বনমানুষ। ‌বানর ও হনুমান থেকে উল্লুকের প্রধান পার্থক্য হলো এরা পরিবারভুক্ত ও লেজবিহীন। উল্লুক পরিবারকেন্দ্রিক বসবাস করে। প্রতিটি পরিবার বা গ্রুপ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অবস্থান করে। একেকটি দলে দুই থেকে পাঁচটি উল্লুক থাকে। স্ত্রী উল্লুক প্রতি দুই বা তিন বছরে একটি সন্তান জন্ম দেয়। একেকটি পুরুষ উল্লুক এবং নারী উল্লুক অজীবন একত্রেই সংসার করে। কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না। কোনো কারণে কারো মুত্যু তখন নতুন সঙ্গী-সঙ্গিনীকে খুঁজে নেয়ার প্রশ্নটি দেখা দেয়। পুরুষ আর নারী উল্লুক আকারে প্রায় সমান হলেও গায়ের রঙে বেশ পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ ঘন কালো এবং স্ত্রী হলুদ-সোনালি বা ধূসর-বাদামি রঙের। উল্লুক সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। এদের উচ্চতা মাথা থেকে শরীর পর্যন্ত প্রায় ৫৫ সেমি। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজনন মৌসুম।  

ulluk_07


ড. মনিরুল খান আরও বলেন, উল্লুক মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলের প্রায় পঁচিশটি স্থানে উল্লুকের দেখা মেলে। সারাদেশে এদের সংখ্যা দুই থেকে আড়াইশটির মতো রয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বড়লেখা, লাঠিটিলা, সাগরনাল, চাউতলী, কালাছড়া, মাধবকুণ্ড, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, চট্টগ্রামের পাবলাখালী অভয়ারণ্যসহ প্রভৃতি স্থানে উল্লুক দেখা যায়। একটানা ‘থে-উ, হু-উ, হো-কো-উ’ এমন স্বরে উল্লুকরা ডাকে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২০/২২টির বেশি হবে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, উল্লুকের খাদ্য তালিকার ৫১ শতাংশ পাকা ফল, ৩৮ শতাংশ ডুমুর, ৫ শতাংশ ফুল, পাতাকুঁড়ি এবং ৬ শতাংশ পোকা-মাকড়, পাখির ডিম প্রভৃতি। কিন্তু গত কয়েক দশকে যেভাবে বন ও ফলবতী বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে, তাতে উল্লুকের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। লাউয়াছড়ায় বেশি সংখ্যক চাপালিশ গাছ থাকার ফলে এর ফল এরা খেয়ে থাকে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।