ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

শব্দদূষণে নাকাল লাউয়াছড়ার উল্লুক-ভাল্লুক

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন; ছবি: নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪
শব্দদূষণে নাকাল লাউয়াছড়ার উল্লুক-ভাল্লুক

লাউয়াছড়া, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশের মুখেই বনবিভাগের সাইনবোর্ড। তাতে অনেক নিষেধের একটি ‘শব্দ দূষণ রোধকল্পে মাইক এমপ্লিফায়ার (শব্দবর্ধক যন্ত্র) ব্যবহার করা যাবে না’।



প্রথমেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে নীরবতায় প্রকৃতি ভ্রমণ বিষয়ে। অর্থাৎ, লাউয়াছড়ায় যে সব পর্যটক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের সম্ভার উপভোগ করতে আসেন তাদের নিঃশব্দে চলাফেরার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো যে শুধু বলার জন্যই যেন বলা তা টের পেলাম ভিতরে ঢুকে।

ট্যুরিস্ট শপের নিচের জায়গাটায় দাঁড়াতেই প্রথমে মাটিতে কেমন যেন কম্পন অনুভূত হলো।   তারপর বাড়তে থাকলো শব্দ। বুঝলাম ট্রেন আসছে। সবুজ বনের ফাঁক গলে ঠিকরে পড়া আলোক রেখার মধ্যদিয়ে ভয়ংকর শব্দ করে এগিয়ে আসা এ যন্ত্রদানবকে দেখতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু পাশ ঘেঁষে যখন বেরিয়ে গেলো তখন কান ঝালাপালা। মুহূর্তে মনে হলো প্রবেশ পথের সাইনবোর্ডের কথা। সুন্দরের মাঝের এ অসুন্দরকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।



লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইনটি প্রাণীকুলের জন্য এখন প্রধান হুমকি। দিনের পর দিন প্রাণীকূলের সহ্য ক্ষমতার বেশি শব্দ করে চলছে ট্রেনগুলো। বনের মধ্যদিয়ে চলা গাড়িগুলোর অবস্থাও একই। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অতিরিক্ত গতি ও হর্ন বাজিয়ে চলেছে তারা।

নীরব নান্দনিক নিসর্গে এই পরিবেশ বড়ই বেমানান। কিছুক্ষণ পর পর ট্রেনের চলাচল কিংবা বিরামহীনভাবে গাড়ির ছোটাছুটি প্রাণিকূলের জন্য এখন আতংকের কারণ। বছরের পর বছর ধরে চলছে একই অবস্থা। তবে এই তীব্র শব্দে প্রাণীদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথাটিও বলেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে কথা হলে লাউয়াছড়ার বিটের বন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বেশ কয়েকবছর হলো আমি এখানে আছি। আমার মনে হয় বনের প্রাণীরা এতে অভ্যস্ত গেছে। মানুষ কম এলেই প্রাণীদের জন্য ভালো। ট্রেনে সমস্যা নেই।

তবে ট্রেন লাইন সরানো হবে কিনা তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেন নি এই কর্মকর্তা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সরকারের শাসনামলে এখানে বনায়নের সফল বাস্তবায়ন ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এর আগে আঠারো শতকের শেষ দিকে তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের আওতায় লাউয়াছড়ার ভিতর দিয়ে রেল যোগাযোগ চালু হয়।



লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের দায়িত্বে থাকা ক্রেল প্রজেক্ট কর্মকর্তা কাজী নজরুল ইসলাম জানান, লাউয়াছড়া পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীববৈচিত্র্যের সম্ভার। অন্য উদ্যানগুলো থেকেই এটা খুবই সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০ রকমের অর্কিড, ২৪৯ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ৩৯ প্রজাতির সাপ ।

এছাড়াও সারা পৃথিবীর ৪টি দেশে প্রায় ২শর মতো উল্লুক রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের লাউয়াছড়াতেই আছে প্রায় ১২০টির মতো উল্লুক। এই চারটা দেশ হলো দক্ষিণ চীন, মায়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশ।

একটি প্রাণীর পক্ষে ট্রেনের সেই দানবীয় শব্দ সহ্য করার মতো ক্ষমতা আছে কী নেই এ বিষয়টি নিয়ে মুখোমুখি হই বিশেষজ্ঞের।
 


দেশের বরেণ্য পাখি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৃতি বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা রোনাল্ড হালদার বাংলানিউজকে বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্যের চমৎকার এক মহামিলন কেন্দ্র। এখানে বসবাসরত বিরল প্রজাতির প্রাণীদের স্বার্থে এই বনের ভেতর থেকে রেলপথ এবং সড়ক অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি। কিন্তু কার্যত কিছুই হচ্ছে না।

তিনি বলেন, এক সময় লাউয়াছড়া খুবই রেস্ট্রিক্টেড ছিল। ১৯৮৪ সালের দিকে ছিল এটি বালুর রাস্তা। গেটে অনুমতি নিয়ে তবেই এ পথ দিয়ে প্রবেশ করা যেত। তখন এ পথ দিয়ে আমি মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে আসা-যাওয়া করতাম। নানা প্রজাতির পাখি, সাপ, খরগোশ, এমনকি হরিণ পর্যন্ত তখন পেয়েছি। পাকা রাস্তা হওয়ার পর সেই সৌন্দর্য বিলীন হতে শুরু করে।

তিনি আরেও বলেন, মানুষ ও প্রাণীর হেয়ারিং ক্যাপাসিটি প্রায় কাছাকাছি। তবে আমাদের থেকে অনেক শব্দ শুনতে পায় এমন প্রাণীর সংখ্যা কম নয়। এতে কম শব্দ আমরাও শুনতে পাই না। যেমন ধরুন – ২০ থেকে ২০ হাজার হাটস (কম্পন) আমরা শুনতে পাই। কিছু কিছু প্রাণী ১০, ১৫ ডেসিবল শব্দ শুনতে পারে।



রোনাল্ড হালদার আরও বলেন, ৮৫ ডেসিবল শব্দ মানুষ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। ধারাবাহিকভাবে এই শব্দ শুনতে থাকলে আমাদের শ্রবণক্ষমতার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। একটি ট্রেন ইঞ্জিনের শব্দ ৮৫ ডেসিবল। একটা বন্দুকের গুলি নিক্ষেপের শব্দ ১৪০ ডেসিবল। ট্রেনের ইঞ্জিন, বন্দুক, গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন প্রভৃতি হাইরেঞ্জের সাউন্ড মারাত্মক ক্ষতিকর। লাউয়াছড়ার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে রেলপথ এবং সড়কপথটি স্থানান্তর করা বিশেষ প্রয়োজন।

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মো. মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, লাউয়াছড়া সড়ক ও রেলপথটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক কমিটির একটি সভায় আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু এগুলো শুধু আমাদের মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। এখানে রয়েছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং অর্থমন্ত্রণালয়। এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় জড়িত রয়েছে। সেটা হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়।

লাউয়াছড়ার অন্যতম আকর্ষণ উল্লুক, ভাল্লুকসহ বিভিন্ন প্রাণীর জন্য এই মাত্রারিক্ত শব্দ দিনে দিনে বিলীন হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষ ভিতরে ঢুকে যখন দেখে ট্রেন চলছে, বাসের হর্ন বাজছে তখন তারাও শব্দ না করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

তাই সবার আগে প্রয়োজন রেল ও সড়ক পথ লাউয়াছড়া থেকে সরানো। প্রয়োজন সবার সচেতনতা বাড়ানোর। তবেই টিকে থাকবে প্রকৃতির অলংকার প্রাণীরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।