ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

দাদনের জালে অবরুদ্ধ জেলেজীবন

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪
দাদনের জালে অবরুদ্ধ জেলেজীবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলে জীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে।

হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। শূন্য হাতেই ফিরতে হয় ঘরে। দিন আনা দিন খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না, এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারেন না তারা। উপকূল ঘুরে জেলে জীবনের এইসব অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। সাত পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব-     


উপকূল অঞ্চল ঘুরে এসে: নাম তার জালাল উদ্দিন। জীবনভর মাছ ধরার নৌকা চালিয়েছেন। তাই সবাই চেনে জালাল মাঝি নামে। বয়স ৭৫ পেরিয়েছে। এখন অবসরে। কিন্তু জেলে জীবনের দাদনের বোঝা এখনও টানছেন তিনি। মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া দাদনের টাকা বংশ পরম্পরায় শোধ করছেন তার ছেলেরা।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের নাইয়াপাড়ার জেলে জালাল মাঝি সারাজীবন মাছ ধরে কোনো সম্পদ করতে না পারলেও চার ছেলেকেই দক্ষ জেলে করে গড়ে তুলতে পেরেছেন। বাবার ঋণের বোঝা এখন তাদের কাঁধে।

ঠিক জালাল মাঝির মতোই গোটা উপকূলের জেলেদের ঋণের বোঝা স্থানান্তরিত হয় এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাঁধে। জাল-নৌকা বানাতে, নতুন মৌসুমে বেশি মাছের আশায় মহাজনদের কাছে হাত পাততে হয় এদের।

যেটাকে জেলেরা দাদন বলে, সেটাই আসলে মহাজনী ঋণ। এই ঋণের দুষ্টচক্র ওদের পিছু ছাড়ে না। আর এই ঋণের কারণে যুগের পর যুগ ওরা মাহাজনদের কাছেই বন্দি থাকে।

বাংলানিউজের সরেজমিনে উপকূলের বিভিন্ন এলাকার জেলেদের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। মাছ ধরার মৌসুম, কিংবা অন্য মৌসুম, সব মৌসুমেই আলাপ হয়েছে জেলেদের সঙ্গে। ইলিশের মৌসুমে ভোলার দৌলতখানে জেলেদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। কয়েক বছরের মধ্যে বেশ ভালো মাছ পাওয়ায় জেলের মুখে আনন্দের ঝিলিক। কিন্তু নদী থেকে মাছ তুলে মহাজনের আড়তে উঠতে না উঠতেই জেলের সে আনন্দ মিলিয়ে যায়। দাম নির্ধারিত হয় মহাজনের ইচ্ছায়।

ইলিশের মৌসুমে উপকূল ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ধরতে নামার জন্য অগ্রিম দাদন নেওয়ার কারণে জেলেরা প্রতিনিয়ত ঠকছে। মাছের ন্যায্য দাম তারা পায় না। ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুর। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি মাছের আড়ত। মাছের মৌসুমে আড়তগুলো থাকে জমজমাট। নদী থেকে মাছ আসে, আড়তে ওঠে, ট্রাক ভর্তি হয়ে বাইরে চলে যায়।

নদী থেকে ইলিশ নিয়ে আড়তে আসা জেলে আলী আকবর বলেন, আমরা তো ইচ্ছামতো দামে মাছ বিক্রি করতে পারি না। যার কাছ থেকে দাদন নেই, তাকেই মাছে দিতে হয়। এ কারণে অনেক পরিশ্রম করেও আমরা মাছের ন্যায্য দাম পাই না।

ভোলার ইলিশা ঘাটের জেলে আবু জাহের অভিযোগ করেন, নদী থেকে ধরে আনা যে মাছ তারা আড়তে ১২০০ টাকায় বিক্রি করেন, সে মাছ বাইরে ১৫-১৬শ’ টাকায় বিক্রি করতে পারেন।

তিনি বলেন, মাছ পেলে বড় অংশটাই আড়তদারের কাছে চলে যায়। কিন্তু ঝড়-ঝাপটা কিংবা অন্য কোনো ক্ষতিতে জেলেরা কোনো সহায়তা পান না।  

ভোলার দৌলতখান, ইলিশা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, হাতিয়ার বুড়িরচরের অনেক জেলের অভিযোগ, মহাজনেরা একটি সিন্ডিকেট করে মাছের দাম কমিয়ে রাখে। আড়তে মাছ ওঠার পর ডাকের মাধ্যমে দাম হাঁকা হলে সেটাও থাকে লোক দেখানো। ফলে উদয়াস্ত পরিশ্রমের পরেও জেলেরা দুই কেজি চাল নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে না।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতি দৌলতখান শাখার সভাপতি ও আড়তদার আলমগীর হোসেন। বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আড়তে মাছ নিয়ে এসে জেলেরা কখনোই ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় না। এখানে দাম হাঁকা হয়। সবাই দাম বলে। সর্বোচ্চ দামটাই পায় জেলেরা।  

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের চরবংশী ইউনিয়নের নাইপাড়ায় গিয়ে দেখা মেলে দাদনের কারণে নিঃস্ব বহু জেলের। মহাজনের দেনা শোধ করতে না পেরে এই এলাকার বহু জেলে জীবিকার খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। কথা বলতে গিয়ে এমন জেলের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। দুই লাখ টাকা থেকে শুরু করে কেউ কেউ ৬-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

নাইয়াপাড়ার জেলে আজিজ হাওলাদার ৭ লাখ, নূর মোহাম্মদ দেড় লাখ, নাছির বেপারী ৬ লাখ, আপন হাওলাদার ২ লাখ, বাবুল বেপারী ৩ লাখ, ছালেম বেপারী দেড় লাখ, জাকির বেপারী ৩ লাখ, খায়ের দেওয়ার ৪ লাখ, কাঞ্চন আলী ৩ লাখ, কামাল মাঝি ৬ লাখ, আনোয়ার হোসেন ৪ লাখ টাকা দেনার বোঝা নিয়ে আছেন। দেনা শোধ করতে না পেরে এদের অনেকেই কাজের সন্ধানে শহরে ছুটছেন।  

এখানকার জেলেরা জানালেন, মাছ ধরতে গিয়ে তিন ধরনের ঋণের ওপর জেলেরা নির্ভরশীল। মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য আড়তদারেরা দাদন দেন। এ টাকা জেলেরা জাল-নৌকা তৈরি বা মেরামতে ব্যয় করেন। কেউ কেউ এনজিওর কাছ থেকেও ঋণ নেন। আবার অনেকে মাছ ধরার জন্য হাত পাতেন গ্রাম্য মহাজনের কাছে।           

জেলেরা জানান, এদের জীবিকা মাছ ধরা। এর বাইরে অন্য কোনো কাজকর্ম এদের জানা নেই। এদিকে মাছ ধরার জন্যও প্রয়োজনীয় পুঁজি নেই এদের কাছে। বংশ পরম্পরায় দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা এদের জীবন। সে কারণেই মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের হাত পাততে হয় মহাজনদের কাছে।        
      
সিরিজের পরবর্তী পর্ব সমূহ তিন:
মাছের উৎপাদন বাড়ে, জেলেরা মাছ বেচে পানির দামে চার: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই পেশায়, অবস্থা বদলায় না পাঁচ: জলবায়ু পরিবর্তনে ওলট-পালট জেলে জীবন ছয়: বিধবা জেলে বধূদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার সাত: জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি 

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪

* দস্যু-দুর্যোগের ভয়, তবুও সমুদ্রে যেতে হয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad