ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

প্রেমিক-প্রেমিকার অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন; ছবি: নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪
প্রেমিক-প্রেমিকার অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া

লাউয়াছড়া, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: পশু-পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। সরকারিভাবে সংরক্ষিত এ বনটির অলংকার এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিপন্ন-মহাসংটাপন্ন প্রাণীদের অবাধ বিচরণ, বিচিত্র প্রজাতির গাছ-লতার সমাহার।

সময়ের বিবর্তনে বনের প্রাণীরা অভয়ে বিচরণ করতে না পারলেও অবাধে বিচরণ করতে পারেন প্রেমিক-প্রেমিকা, কখনো-সখনো ভাসমান যৌনকর্মীরা!

পৃথিবীর মানচিত্রে গৌরবময় এক স্থান দখল করে রয়েছে আমাদের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। লাউয়াছড়ায় বৃক্ষ নিধনের অভিযোগ বহু পুরনো। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা গেল, কিছু বিপদগামী তরুণ-তরুণী কিংবা যৌনকর্মী বনের নির্জনতায় অনৈতিক কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়েন। আর একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী স্থানীয় সংঘবদ্ধচক্র সেসব তরুণ-তরুণীদের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা, মোবাইল প্রভৃতি।

প্রেমিকযুগলদের জন্য ক্রমে অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে বনটি। ভাসমান যৌনকর্মীদের এনে ফূর্তি করাসহ চলছে সব ধরনের অনৈতিক কাজ। সব জেনেও নীরব বিট কর্মকর্তারা। আর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা ব্যস্ত এসব অনৈতিক কাজে সহায়তা করে টু-পাইস কামানোর তালে।

লাউয়াছড়া বনবিটে উল্লুক অর চশমা হনুমানের পিছে সেদিন ছিল আমাদের প্রথম ছোটাছুটি। বনের প্রশিক্ষিত ইকোগাইডদের না নিয়ে সঙ্গে নিলাম স্থানীয় একজন গাইড। উল্লুক, বানর দেখবো বলে সোজা পথে না গিয়ে আমরা গেলাম বনের ভিতর দিয়ে একটু বিপথে। উল্লুক না পেলেও দেখা পেলাম চশমা পরা বানরের। সে গল্প আরেকদিন।
bg1_78
আমরা ঢুকেছিলাম তিন ঘণ্টার ট্রেইল দিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে উঠলাম একটি টিলার উপর। এই গহীন বনের টিলার উপর উঠে পরিবেশটা কেমন যেন অচেনা ঠেকলো। অচেনা এই অর্থে যে, এখানে নুডুলসের প্যাকেট, স্যুপের প্যাকেট, চকলেটের খোসা, পানির বোতল ছড়ানো। প্রতিটি গাছের গোড়ায় মানুষের বসে থাকার চিহ্ন। রয়েছে চটের বস্তা, খবরের কাগজ। এতক্ষণ বনের অনেকটা অংশ ঘুরেও এ দৃশ্য দেখা যায়নি। গাইডের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলাম। এরপর বেরিয়ে এলো থলের বিড়াল।

জানা যায়, এই টিলাটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। প্রতিদিন অসংখ্য যুগল এখানে আসেন নির্জনে সময় কাটাতে। সঙ্গে নিয়ে আসেন নানা ধরনের খাবার। তারাই বনের পরিবেশটাকে নষ্ট করছে এভাবে।

চমকের শেষ এখানে নয়, একটু ঘুরে দেখা গেলো গাছের গোড়ায় অন্য জিনিসের সঙ্গে যত্র-তত্র ছড়ানো বিভিন্ন যৌনকাজে ব্যবহার্য বিভিন্ন উপকরণের চিহ্ন। এসবের মধ্যে রয়েছে যৌনউত্তেজক ট্যাবলেটও!

গাইড ও বনের ভিতরে লেবুবাগানে কাজ করা শ্রমিকরা তাদের নাম উল্লেখ না করার শর্তে জানায়, এখানে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অনৈতিক কার্যক্রম চলে। অনেক দূর থেকেও এখানে ছেলে-মেয়েরা আসে। কখনো-সখনো খারাপ মেয়ে (যৌনকর্মী) নিয়ে আসে। অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে উঠতি বয়সের। কেউ কেউ আরও গহীনে চলে যায়।

পুরো এলাকাটা ঘুরে তার কথার সত্যতা পাওয়া গেলো। আরও জানা গেলো এসবের মূল হোতা নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া ইব্রাহিম। তিনি আবার এখানকার নিবন্ধনকৃত ইকোগাইডও। তার বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলাসহ রয়েছে তিনটি মামলা। এখানে ঘুরতে আসা প্রেমিক-প্রেমিকা তো আছেই, অনেক সময় তার যোগসাজশে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেও মোবাইল, ক্যামেরা, টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে। অভিযোগ আছে ইব্রাহিম থাকেন বিট কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের ছত্রছায়ায়।
chora_2_632
লাউয়ছড়ায় তরুণ-তরুণীর অর্থ-মোবাইলসহ মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই ও তাদের লাঞ্ছিত হবার বিষয়ে লাউয়াছড়ার লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) মনিরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি স্বভাবসুলভ দ্রুততার সঙ্গে বলে ওঠেন খারাপ কী ? ভালোই তো করে। বনে-জঙ্গলে এসে আকাম-কুকাম করবে কেন?

এক পর্যায়ে তিনি ইব্রাহিম ও তার দলের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের প্রহৃত হওয়ার ঘটনাগুলো জানেন বলে স্বীকার করেন।

সেসব তরুণ-তরুণীদের আইনের আওতায় কেন আনেন না - এ প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, কি লাভ হবে? মাত্র দু’শত টাকা দিয়ে তারা ছুটে যাবে। অনেক ঝামেলা হয় বলে পুলিশও তাদের  নিতে চায় না।

আর এই ইব্রাহিম সম্পর্কে গাইড, কর্মচারীসহ স্থানীয়দের একটাই মন্তব্য, খুব খারাপ ছেলে। যদিও তাদের সঙ্গে বাইরে বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ইব্রাহিম ঘুরতে আসা যুগলদের মারধর করে, কখনো ছেলেটিকে আটকে রেখে মেয়েটির সঙ্গে খারাপ আচরণ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর বিট অফিসার তাকে ব্যবহার করেন।

একটু ঘুরে দু’য়েকটি যুগলকে দেখা গেলো কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজেদের মতো সময় কাটাতে।

লাউয়াছড়ায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন তিনজন পুলিশ। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সাধারণ পর্যটকদের নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে ভয়-ভীতি দেখানো তাদের প্রধান কাজ। আর দু’একশো টাকার বিনিময়েও অনৈতিক কাজে সাহায্য করে তারা।

কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নীহার রঞ্জন নাথ বলেন, এ ধরনের অভিযোগ তো কেউ আমাকে করেনি। আর পুলিশ দেরিতে আসার বিষয়টি আমি দেখবো।

এ ব্যাপারে লাউয়াছড়া বিটের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, যুগলদের এবং কখনো যুগল সেজে আসা মানুষ সম্পর্কে তারা অবহিত। কিন্তু লোকোবলের অভাবে তারা কিছু করতে পারছেন না।

পুলিশ সম্পর্কে তিনি বলেন, পুলিশকে কিছু বললে পুলিশ বলে, এদের ধরে কোর্টে চালান করতে যে কষ্ট আর খরচ তাতে তাদের পোষায় না। কারণ একাজের শাস্তি খুব কম। অথচ থানায় নেওয়া, চালান দেওয়ার ঝক্কি বেশি।
ora_0
ইব্রাহিম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি নিজে অনেককে অনৈতিক কাজের জন্য পিটিয়েছি। এখন আর ভালো লাগে না। ইব্রাহিম মাঝে-মধ্যে পেটায়। এখানে আসা এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অধিকাংশ হবিগঞ্জ, কমলগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার।

 তার দাবি ইব্রাহিম আছে বলেই অনেকে এসব কাজ করতে সাহস পায় না।

ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে দেখা লাউয়াছড়ার ত্রাস ইব্রাহিমের সঙ্গে। ইকোগাইড হলেও তার পোশাক-আশাক, মোটরবাইক দেখে নবাবপুত্র বলে ভুল করবেন অনেকে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাবার নাম জিজ্ঞেস করায় বেরিয়ে এলো তার প্রকৃত রূপ। ক্ষেপে গিয়ে বললো, বাবার নামের কি দরকার। আমি একজন ইকোগইড, কমলগঞ্জ কলেজের ছাত্র, ছাত্রলীগ নেতা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য এটাই আমার পরিচয়।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বনের মধ্যে কেউ যদি এ ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে তবে তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আমাদের। কাউকে পেটানোর দায়িত্ব বা লাঞ্ছিত করার দায়িত্ব নয়। এটা যদি বিট কর্মকর্তা বলে থাকেন তবে তিনি অবান্তর কথা বলেছেন। সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইব্রাহিমের খুঁটির জোর কমলগঞ্জ আওয়ামী লীগ উপজেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক সিদ্দেক আলী। সম্পর্কে ইব্রাহিম তার তালতো ভাই।

কমলগঞ্জ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহেদুল আলম বলেন, ‌ইব্রাহিম কমলগঞ্জ আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের কোনো কর্মী নয়। প্রায় তিন বছর আগে ‌দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্টের সত্যতায় তাকে আমাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
 
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মৌলভীবাজারের এএসপি (সার্কেল) মো. আশরাফ বলেন, কোনোভাবেই এ ধরনের সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। দ্রুত তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।