ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

মিরাশ মিয়ার মিরাকল

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন; ছবি: নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪
মিরাশ মিয়ার মিরাকল ছবি:নূর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাইক্কা বিল, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: পড়েছেন ১০ শ্রেণি পর্যন্ত। করতেন গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা।

১৯৮৪ সালে শুরু। গাছ-মাছ-পাখি অন্তপ্রাণ। এসবের টানে ছাড়লেন শিক্ষকতা। গড়ে তুললেন একটি সেবামূলক সংগঠন। বাইক্কা বিলের চারপাশে সম্মিলিত উদ্যোগে লাগালেন ৩৫ হাজার হিজল-তমাল।

সহযোগিতাও পেলেন। পাখিদের অঘোষিত অভয়াশ্রম এটি। তাদের উদ্যোগে বিলটা হলো মাছের অভয়াশ্রম, একই সঙ্গে পাখিরও। এখন অতন্দ্র প্রহরী এই মাছ-পাখির।
 
বলছি মিরাশ মিয়ার কথা। বাইক্কা বিলের পাখি দর্শনার্থী টাওয়ারের দায়িত্বে নিয়োজিত তিনি। তিন সন্তানের জনক তিনি। সংসারে অভাব। দেড় বছর বয়সে মার কোল থেকে নৌকায় পড়ে যান মিরাশ মিয়া। পায়ে পেরেক গেঁথে যাওয়ায় পা আর সুস্থ হয়নি। বাঁকা পা দিয়েই এখন হাঁটতে হয় তাকে।


তাতে কি! নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন এই বিলের জীববৈচিত্র্য। ওয়াচ টাওয়ারের যেই আসুক খুব আগ্রহভরে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দূরবীনে চোখ রেখে চেনান বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি। নতুন কোনো প্রজাতির পাখি দেখলেই চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে তার। সঙ্গে সঙ্গে খবর দেন পাখি বিশেষজ্ঞদের। তার ডাকে আসেন বিভিন্ন পাখি গবেষক, বার্ড ক্লাব সদস্যরা।

আগ্রহ আর লক্ষ্য যার অসীমের দিকে, কোনো সীমা তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। সব বাধা অতিক্রম করে প্রকৃতির অবলা প্রাণীদের রক্ষা করে চলেছেন। বিনিময়ে যা পান তাতে অভাব কাটে না। সেটা তার কাছে মুখ্য বিষয় নয়।
 

পরিযায়ী পাখিসহ দেশি প্রায় সব পাখির নাম বৈজ্ঞানিক ও ইংরেজি নামসহ মুখস্ত তার। সব সময় হাসিমুখ। কোনো বিরক্তি নেই। ওয়াচ টাওয়ারে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় তার সঙ্গে। কথার ফাঁকে কয়েকবার উঠে গেলেন নতুন কোনো পাখি এসেছে কিনা দেখতে। দূরবীনে চোখ রাখতে রাখতে তার চোখও হয়ে গেছে প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন। দূর থেকে পাখির নড়াচড়া দেখলেই যেন বুঝতে পারেন নতুন কোনো পাখি এটি।
 

এবছর দুই প্রজাতির নতুন পাখি এসেছে বলে জানালেন মিরাশ মিয়া। এ নিয়ে তার হিসাব মতে বাইক্কা বিলে আসা পাখির প্রজাতির সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ১৬৬তে। তবে সরকারি হিসাব সবসময় মেলে না তার সঙ্গে।
 
আক্ষেপের সুরে তিনি বললেন, যত দিন যাচ্ছে তত পাখির প্রজাতির সংখ্যা এ বিলে বাড়ছে, কিন্তু কমছে সংখ্যা। আগে অনেক পাখি আসতো। পুরো বিল ছেয়ে যেত রং-বেরঙের পাখিতে। এখন গড়ে ২০-২৫ হাজার পাখি আসে। আমি ঠিকই বুঝতে পারি। আন্দাজ হয়ে গেছে।
 
পাখির সংখ্যা কমার কারণ জিজ্ঞেস করতে তিনি বলেন, পাখিরা সন্ধ্যা হলে কেউ কেউ পাশের অন্য বিলগুলোতে চলে যায়। সেখানে থাকে চোরা শিকারিরা। তারা পাখি ধরে। যখন দূর দেশ থেকে আসা একটি দলের পাখিকে কেউ ধরে তখন তার ভীত হয়ে যায়। হয়তো এমনও হয় তারা পরের বছর আর অসেই না।
 

এসব শিকারিদের কেউ দেখার নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখবে কে? পাখি যা তো মন্ত্রী, এমপি, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘরে। এগুলো জেনেও আমরা তো কিছু করতে পারি না। সবাই ভয় পায়। রক্ষকই ভক্ষক। আমরা কয়েকজন প্রহরী আছি এখানে। এখানে কোনো পাখির ক্ষতি হতে দেই না। শালিক, সুইচোরা, আবাবিল প্রভৃতি পাখির জন্য তো এই হিজল, তমাল গাছ লাগিয়েছি। সন্ধ্যা হলেই দেখবেন এদের ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাবে।
 
কোন দেশ থেকে কোন পাখি আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে আসে তিলা লালপা, গ্রে হ্যেরন উপকূলীয় অঞ্চলের পাখি, লালচে বক, পুলুটির হাঁস এসেছে সাইবেরিয়া থেকে। মাত্র দুদিন আগে আসা এই পাখিরা সাইবেরিয়ার। পাখিটি এখন বিলুপ্ত। তিব্বত থেকে আসে চখাচখি, দাগী রাজহাঁস, ধূসর রাজহাঁস। এছাড়া পাতি সরালি, রাজ সরালি, আমাদের বেগুনি কালেম, গ্রি হাঁস, পিয়াং হাঁস, পাতি তিলিহাঁস, লেঞ্জা হাঁস প্রভৃতি তো আছেই।
দূরবীনে দুটি কালো মাথা কাস্তেচরা দেখিয়ে বললেন, এরা এসেছে মাত্র দুদিন আগে। থাকবে বেশ কিছুদিন।
 

মিরাশ মিয়া জানান, ১৯৯৯ সালে ইউএসএআইডি’র সহায়তায় তারা বিল সংরক্ষণের প্রথম উদ্যোগ নেন। ২০০২ সালে গাছ লাগান প্রায় ৩৫ হাজার। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে হাইল হাওরের অংশ এই বাইক্কা বিলকে ঘোষণা করেন মাছের অভয়াশ্রম।
 
তিনি আরও জানান, এই বিলে মাছেরা নিরাপদে প্রজনন করতে পারে। ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বিপন্ন মাছ সুযোগ পায় এখানে বড় হয়ে আশপাশের অন্য বিলগুলোতে ছড়িয়ে যেত। এখানে রয়েছে, কালিবাউশ, কাতল, রানি মাছ, মনি মাছ, পাবদা, খানি পাবদা, মধু পাবদা, বাঁশপাতা,ফলই, কই, টাকি, দারবিনা, লাচো, গাগলা, চিতল, আইড়, তারা বাইন, জাতি পুঁটি লাল চাঁদাসহ একশো প্রজাতির বেশি মাছ।
 

সারা বছরেই এ বিলে পাখি থাকে বলে জানালেন মিরাশ মিয়া। বিশেষ করে নিউপিপি, দলপিপি, বেলেহাঁস প্রভৃতি পাখি।

হাওর অঞ্চলের এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কি করা উচিত- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাওরগুলো রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বাইক্কা বিলের মতো আরও বিলকে অভয়ারণ্য করতে হবে। বন্ধ করতে হবে সরকারি কর্মকর্তাদের পাখি ভোজন। তবেই এটা রক্ষা হবে।

শিক্ষকতা ছেড়ে, স্ত্রী সন্তানদের দূরে রেখে, খোড়া পা নিয়ে এভাবে কেন জীবন কাটাচ্ছেন- সবশেষে এ প্রশ্ন করলে মিরাশ মিয়া বলেন, আমি প্রকৃতিকে ভালোবেসে যদি কিছু দিতে পারি সেই ইচ্ছা নিয়েই এখানে এভাবে আসা, থাকা। এই সিজনে রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। এখানে আমরা চারজন আছি। সবার চেহারা দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন। আর পাখিগুলোকে আমি এত ভালোবাসি যে আমার জীবন থাকতে একটি পাখিকেও এই বিলে আমি মরতে দেব না।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।