ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বাইক্কা বিলের বেগুনি কালেম

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন; ছবি: নূর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৪
বাইক্কা বিলের বেগুনি কালেম ছবি: নূর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাইক্কা বিল, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে: কুয়াশা ছেড়ে সবে রোদ উঠেছে। মিষ্টি আলো বিলজুড়ে।

রং-বেরঙের পাখি সেই আলোয় মাখিয়েছে নতুন রং। আর নানা পাখির গান তো আছেই। একশো একরের বাইক্কা বিলে ঢুকেই দেখা মিষ্টি চতুর পাখি বেগুনি কালেমের।

খুব চালাক পাখি এরা। সতর্ক খুব। কাছে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। তবু পা টিপে টিপে ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর চলে গেলেন কাছাকাছি। আমরাও খুব খুশি এমন চমৎকার একটি পাখি বাইক্কা বিলে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোয়। তবে খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কয়েকটি ক্লিক পড়ার পরেই অমনি লম্বা পা গুটিয়ে গেলো উড়ে।

এত বড় জলাশয়ের হাজার হাজার পাখির ভিড়ে এই পাখিকে খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয় না। তাদের গায়ের রঙই জানান দেয় অবস্থান। দৃষ্টি প্রসারিত করে খুব সহজেই কালচে-সবুজ কচুরিপানার পাতার আড়ালে শনাক্ত করা যায় তাদের। কচুরিপানা তাদের প্রিয় স্থান। বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা যায় না। হাতেগোনা কয়েকটি সংরক্ষিত জলাভূমি ছাড়া এদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। মাঝারি আকারের দৃষ্টিনন্দন এই জলজ পাখিটির প্রকৃত নাম ‘কালেম’। কেউ কেউ একে ‘বেগুনি কালেম’, ‘কায়িম’ বলে থাকেন।  

শ্রীমঙ্গলের সংরক্ষিত বাইক্কা বিলের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তারা। প্রথম দেখার পর আমারা চলে গেলাম পাখি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। মাঝে কিছুক্ষণ ঢুঁ মারলাম কোরা ঈগলের পিছে। তার গল্প আরেকদিন। পাখি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের উপর উঠে চোখ ফেরাতেই দেখা যায় শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানা প্রভৃতি জলজ উদ্ভিদ। আর দূরবীনে চোখ রাখলেই অন্য পাখির মাঝে আলোকিত বেগুনি কালেম।  

টাওয়ার থেকে নেমে নৌকা নিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম আরও কাছে। নূরের দেখা গেলো বিশেষ মনোযোগ কালেম নিয়ে। কত ধরনের চেষ্টা তার। শুধু সুন্দর এই পাখিটিকে আরও সুন্দররূপে উপস্থাপন করার জন্য। সতর্কচিত্তে সবুজ জল ঠেলে কাছাকাছি গিয়ে পাওয়া গেলো বেশ কয়েকটি ছবি। এবার একটু হাসি নূরের মুখে। তবু যেন সন্তুষ্ট নয়।

মানুষকে বিশ্বাস করতে এদের বড় ভয়। কারণ এদের প্রধান যম যে তারাই। একটু আওয়াজ পেতেই চাক চাক ডেকে মাথার উপর দিয়ে উড়াল দিলো। কালেমদের একসঙ্গে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি বড়ই মনোরম। তবে যতক্ষণ এদের হেঁটে চলতে ফিরতে দেখবেন ততক্ষণ ভাবতে একটু কষ্ট হবে এরা আবার উড়তেও পারে!

এর ইংরেজি নাম Purple Swamphen এবং বৈজ্ঞানিক নাম Porphprio porphyrio।

কালে নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, বেগুনি কালেম বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। পৃথিবীতে ৬ প্রজাতির এ পাখির মধ্যে বাংলাদেশের জলাশয়ে মাত্র এক প্রজাতির কালেমকে বিচরণ করতে দেখা যায়। তাদের মাথার চাঁদি বর্মে ঢাকা। ঠোঁটের গোড়া মোটা এবং ঠোঁট দু’পাশ থেকে চাপা। ডানা গোলাকার। তবে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ প্রান্তের পালক সবচেয়ে দীর্ঘ। পা এবং আঙুল বেশ লম্বা ও শক্তিশালী। খাবার খাওয়ার সময় এরা লেজের নিচের সাদা অংশ প্রদর্শন করে ও ডাকে চাক চাক। বেগুনি কালেম হাওর, বিল, নলবন ও ঘাসওয়ালা জলাভূমিতে বিচরণ করে। সাধারণত এদের ১০ থেকে একশোটির দলে দেখা যায়।

ইনাম আল হক আরও জানান, এদের দৈর্ঘ্য ৪৫ সেমি.। ওজন ৬৫০ গ্রামের মতো। ডানার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ সে.মি, ঠোঁট ৪.৫ সে.মি, পা ৯ সে.মি, এবং লেজ ১০ সে.মি হয়ে থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

জলজ পাখি কালেমের শরীরের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে নীলচে বেগুনি রঙের শোভা। তবে মাথা ও গলা ফিকে রঙের, ডানা সবুজ ও লেজতল সাদা রঙের। ঠোঁটের গোড়া থেকে মাথার পেছন পর্যন্ত বর্ম অর্থাৎ, লাল এক আবরণ রয়েছে। স্ত্রী-পুং উভয় লিঙ্গের পাখির চোখের রং রক্তলাল। সাধারণত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু হাওরে এদের দেখা মেলে। ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত এদের বৈশ্বিক বি¯তৃতি রয়েছে।

বাইক্কা বিলের পাখি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দায়িত্বে থাকা মিরাশ মিয়া জানান, বাইক্কা বিলের কালেম দেখা যায় মূলত ৯ মাস। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এরা চলে যায় পাহাড়ি এলাকায়।

তাই কালেম পাখি দেখার জন্য বছরের এই নয় মাসকে বেছে নিতে পারেন আপনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।