ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বাড়ছে কালো ধোঁয়া ও বায়ু দূষণ

ড. ফোরকান আলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৪
বাড়ছে কালো ধোঁয়া ও বায়ু দূষণ

বাতাস ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তবে তা হতে হবে নির্মল।

নির্মল বায়ু যেমন মানুষকে বাঁচাতে পারে, তেমনি দূষিত বায়ু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। প্রকৃতির দান এই অমূল্য সম্পদ নির্মলই থাকে। কিন্তু মানুষই তাকে দূষিত করে।

আমরা জানি যে, বাযুর অ্যতম উপাদান অক্সিজেন মানুষ গ্রহণ করে আর কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে। বায়ুতে অধিক অক্সিজেনের জন্য অধিক গাছপালার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে গাছপালা কেটে উজাড় করায় বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বায়ু দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। গাড়ি, লঞ্চ-স্টিমারের কালো ধোঁয়া, কলকারখানার কালো ধোঁয়া ও বর্জ্য বায়ুকে দূষিত করছে।

বাংলাদেশ একটি ঘণবসতিপূর্ণ দেশ। সত্তরের দশকে এদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ কোটিতে। এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য যানবাহনের সংখ্যাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই যানবাহনগুলো প্রতিনিয়ত কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। যা নির্মল বায়ুকে দূষিত করছে। ইট পোড়ানোর কারণে নির্গত কালো ধোঁয়াও এজন্য কম দায়ী নয়।

বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি শহরগুলিতে বায়ু দূষণ মারাত্মক রূপ নিয়েছে। যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, ধূলিকণা প্রভৃতি বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। বিশেষ করে মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়িগুলো এতো বেশি কালো ধোঁয়া ছড়ায় যা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান নগরায়নের ফলে গাছপালা কেটে উজাড় করার কারণে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে। এতে করে বাতাসে দূষিত পদার্থের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটির অধিক লোকের বাস। এই বিপুল জনসংখ্যাও বায়ু দূষণের কারণ। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখায় তা পচে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়ায়। নির্মল বায়ুর জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশের দাবি উঠেছে সর্বমহল থেকে। পরিবেশবিদরা শহর থেকে ত্রুটিযুক্ত যানবাহন তুলে দেওয়ার দাবিটি অব্যাহত রেখেছে। সরকারও এ বিষয়টি উপলব্ধি করছে এবং কয়েকবার এসব যানবাহন তুলে দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছেন। কিন্তু গাড়ি মালিক ও চালকদের চাপে পিছিয়ে গেছে সরকার ।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণের দিক থেকে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্য যে কোনো বড় শহরের চেয়ে অনেক বেশি। এখানকার বাতাসে এত বেশি দূষিত পদার্থ মিশে আছে যে, যে কোনো সাধারণ মানুষই রাজপথে হাঁটতে গেলে টের পাবেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলাচল করে।

এগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া মূলত অদগ্ধ কার্বণ যা ছোট ছোট কণার আকারে নির্গত হয়। অনেক পরিবেশবিদ ঢাকার বায়ুতে সীসার কণার উপস্থিতি ব্যাপকতর বলে উল্লেখ করেছেন।

পরিবেশবিদরা ত্রুটিযুক্ত যানবাহন চলাচলের উপর জোর আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, যানবাহনের নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢাকা নগরবাসী বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিবছর বায়ু দূষণের কারণ ১৫ হাজার মানুষ অকালে মারা যায় এবং ৬৫ লাখ মানুষ মারাত্মক অসুস্থতা, ৮৫ লাখ মানুষকে ছোট-খাটো অসুস্থতার শিকার হয়। বিশ্বব্যাংক এবং ইসম্যাপ পরিচালিত দ্য ঢাকা অটো ক্লিনিক প্রোগ্রাম শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, বায়ু দূষণের মারাত্মক ফল স্বরূপ। গত ৮ বছরেই মৃত্যুবরণ করেছে ৮ হাজার ১৩৯ জন এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে ২২ লাখ ২১ হাজার ৬৩৮জন। এদের মধ্যে ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৩৯জন। একই রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৬ জন এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন আরো ১১ হাজার ৪৭৪ জন।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রাকে মারাত্মক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দূষণের ক্ষেত্রে ঢাকাকে উল্লেখযোগ্য বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষণায় ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বায়ূ দূষনের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে বায়ু দূষণের হার ৫০ দশমিক আর আর্ন্তাতিক স্ট্যান্ডার্ড হলো ১৫ (ইএডি)।
অপর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সীসাযুক্ত বায়ুর কারণে দেশের অসংখ্য শিশুর জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, বোয়ালখালী উপজেলা সদরের সবচেয়ে জনবহুল সড়কের চারপাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওয়েল্ডিং কারখানা। ফলে কারখানা থেকে গ্যাস ও ইলেকট্রিক ওয়েল্ডিংয়ের তিন হাজার থেকে ১২ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস আলোর তীব্রতা ও বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডে অগণিত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

শিবগঞ্জ উপজেলায় দুই শতাধিক ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের মোটর, ট্রাক, বাস, টেম্পো, কোস্টার ও মাইক্রোবাস চলাচল করছে। এগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এসব দূষিত ধোঁয়া মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ফলে স্থানীয় লোকজন একজিমা, হাঁপানি, আমাশয় এবং ম্যালেরিয়া রোগে ভুগছেন।

এছাড়া উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র পুরাতন ব্যাটারি গলিয়ে দস্তা বের করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় কালো বিষাক্ত দোঁয়ায় পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। ক্ষেতের ফসল, গাছপালা মরে যাচ্ছে। যেসব এলাকায় এভাবে দস্তা বের করা হয় তার দুই তিন মাইলের মধ্যে বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এলাকার শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে আনোয়ারা, পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়ার জনবহুল এলাকায় অবাধে ইটখোলা নির্মাণ করে ইটখোলার মালিকরা মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করছে।

নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মিত ইটখোলাগুলির ব্যাপারে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ থেকে অভিযোগ উত্থাপন করা সত্ত্বেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এলাকার প্রভাবশালী মহল ইটখোলার মালিকানায় জড়িত থাকাতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশে বায়ু দূষণের সমীক্ষা চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসাম দেখেছেন যে, বেবিট্যাক্সি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় উদ্বায়ী জৈব যৌগের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৭ গুণ বেশি। তিনি বলেছেন, বেবিট্যাক্সি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী টোলুইনের সন্ধান পাওয়া গেছে। টোলুইনের মাত্রার সীমা হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ২০০০ মাইক্রোগ্রাম। অথচ সেখানে বেবি ট্যাক্সির ধোঁয়ায় পাওয়াগেছে প্রায় প্রতি ঘনমিটারে দুই লাখ মাইক্রোগ্রাম।

উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকায় নিষিদ্ধ বেবিট্যাক্সি গুলি খুলনাসহ বিভিন্ন শহরে স্থান করে নিয়েছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। ঢাকা শরহ থেকে বেবিট্যাক্সি তুলে দেওয়ার পর ও সমাধান হয়নি। বাস, ট্রাক ও অন্য যানবাহনের কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে সারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালো ধোঁয়া ও ধূলিকণাযুক্ত দূষিত বায়ু থেকে মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। রাস্তায় মাক্স না বেঁধে হাঁটা যায় না। তাছাড়া কতক্ষণ হাঁটলেই চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়তে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। এর কারণ শ্বাসনালিতে দূষিত সীসাযুক্ত বায়ু গিয়ে ঘা বা ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এ কারণে ঢাকায় প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার বেড়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন শিশু চিকিৎসকরা। গর্ভবতী নারীদের শরীরে সিসা প্রবেশ করলে নবজাতক শিশু সেই সীসা শরীরে নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এ কারণে আগামীতে ঢাকা শহরে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মের হার বেড়ে যাবে।


কারণ, বায়ুতে অতিরিক্ত সীসা দূষণ হওয়ায় সদ্যজাত শিশুর দেহে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এর ফলে তাদের রক্তে সীসার পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে বস্তি ও ঘণবসতিপূর্ণ এলাকার শিশুদের রোধ শক্তির ওপর ক্রমবর্ধমান প্রভাব পড়ছে। ফলে এসকল এলাকার শিশুদের বুদ্ধিসত্তা হ্রাস পাচ্ছে। জাতীয় দৈনিক প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, খুলনা, চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশপাশের এলাকায় বায়ু দূষণ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ এমনকি আরো বেশি দূষিত বায়ুর নমুনা সংগ্রহ করেছে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তর। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটের ভাটা এবং শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও বস্তুকণা এই দুষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে সরকার অবিলম্বে বায়ুকে দূষণমুক্ত করার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেবে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এক্ষেত্রে সরকার দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন চালিত সকল ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। নতুন লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে পুরোনো মডেলের কোনো গাড়িকে লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়িকে সিএনজি চালিত গাড়িতে রূপান্তরের জন্যে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। তাহলেই দেশ ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবল থেকে পরিত্রাণ পাবে।

পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য পাতায় লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।