ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বাইক্কা বিলের বাঁকে, পাক-পাখালির ঝাঁকে

আসিফ আজিজ ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৪
বাইক্কা বিলের বাঁকে, পাক-পাখালির ঝাঁকে ছবি: নূর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল থেকে: আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ। প্রকৃতির নীরবতা ভেঙে ছুটে চলেছে আমাদের তিন চাকার বাহন।

দুপাশে কুয়াশামাখা নরম রোদ। হঠাৎ কানে এলো পাখির গান। ম্লান হলো আমাদের অটোরিকশার যান্ত্রিক শব্দ। বুঝলাম সামনের বাঁক পেরুলেই বাইক্কা বিল।
 
ড্রাইভারকে বললাম একটু ধীরে চলতে। বাঁক ঘুরেই একটি মাঝারি আকারের বিল। থমকে দাঁড়ালাম আমরা। দুচোখে বিস্ময়। কয়েকশ’ পাতি সরালি, ছোট ডুবুরি কিচিরমিচির ডাকছে, দিচ্ছে জলডুব। বাইক্কা বিল এখান থেকে দুইশ’ গজ দূরে। তবে বাইক্কার মোট পাখির বড় একটি অংশ কিছুটা সময় কাটায় এখানে।

দারুণ এ বিলটি। আগে থেকেই পাখিপ্রেমীদের জানান দেয় যে, সামনে অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। অনেকটা সিনেমার আকর্ষণীয় অংশ নিয়ে নির্মিত ট্রেইলারের মতো।
 
এগোলাম আমরা। দূরে চোখে পড়লো একটি লম্বা টাওয়ার (আর্টিফিশিয়াল নেস্টিং প্লাটফর্ম)। তাতে বসে আছে বড় একটি পাখি। আগ্রহ জাগলো জানতে। ফটোগ্রাফার নূর ছুটলো ছবি নিতে। জানা গেলো এটি বিরলপ্রজাতির কোড়া ঈগল। আর টাওয়ারটি বানানো তারই জন্য। সে গল্প আরেকদিন।

বিলজুড়ে পদ্মপাতায় তখনো শিশিরের খেলা। তার মাঝে বেগুনি কালেমের ঝাঁক। খুব সতর্ক পাখি এরা। কাছ থেকে বাইক্কা বিলে পাখি দেখায় হাতেখড়ি হলো। প্রথমেই মুগ্ধ করলো মায়াবি কালেম।
 
এগিয়ে গেলাম আমরা। সামনে বার্ড ওয়াচ টাওয়ার। এখানে উঠে পর্যবেক্ষণ করা যায় কয়েকশো প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী পাখি। রয়েছে একটি শক্তিশালী দূরবীন। আন্তরিকতার সঙ্গে সেখানে পাখি চেনাবেন পাখিপ্রাণান্ত মিরাশ মিয়া। ভারি অদ্ভুত প্রক‍ৃতির লোকটি। মিরাশ মিয়ার মিরাকল জানাবো আরেকদিন।

টাওয়ার থেকে পাখি দেখা যায় বটে, তবে আমাদের তাতে মন ভরলো না, যেতে চাই কাছাকাছি। মোখলেস মিয়ার নৌকা নিয়ে নেমে পড়লাম বিলে। মনে হলো সত্যি এসেছি কোনো পাখির রাজ্যে। যে রাজ্যের অধিপতি কালেম,সরালি, পানকৌড়ি, বালিহাঁস, বক, জলমুরগি, দলপিপি, জলপিপি সবাই।
 
প্রখর রোদ, দুপুরে খাবার না পাওয়ার মৃদু টেনশন, শীতের কুয়াশামোড়া সকালে ঘুম থেকে ওঠার সব কষ্ট, ক্লান্তি ভুলে গেলাম মুহূর্তে। পদ্ম, শালুক, নলখাগড়াবন ঠেলে জলকেটে চলতে থাকলো আমাদের নৌকা। নূরের হাতের ইশারায় নৌকার লগি আটকে দিলেন মাঝি। প্রখর চোখ ক্যামেরার লেন্সে। সামনে একটি বিরল প্রজাতির ধূসর বক। বেশ বড়, লম্বা গলা তার। এসেছে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে।

একঝাঁক পিয়াং হাঁস তার পিছে। রয়েছে বেশি কয়েকটি পাতি তিলি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, রাজ সরালিও।
 
এবার নৌকা একটু বাঁক নিলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো একঝাঁক সরালি। আবারো দেখা বেগুনি কালেমের সঙ্গে। পুরো বাইক্কা বিলটা যেন সুন্দর এ পাখিটির দখলে। পরক্ষণেই ডুব দিলো একটি পানকৌড়ি, ভুঁস কেটে উঠলো আরেকটি।

পদ্মপাতার বুক চিরে আমাদের নৌকাটি যখন ছুটছিল সামনের দিকে, অদ্ভুত জল-পাতার মিষ্টি শব্দ মোহাবিষ্ট করছিল। হাত তখন মনের অজান্তেই নামলো স্বচ্ছ সবুজ জলে। ছোট ছোট মলা, পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ছুটছে। সঙ্গে পাখ-পাখালির বিচিত্র কলকাকালি, রং-ঢং, ওড়া-উড়ি সৃষ্টি করলো ভুবনভোলানো অনাবিল আবেশ।
 
এগিয়ে চললাম আমরা আরো নতুনের দেখা চাই। কখনো নৌকা থামিয়ে, কখনো জোরে চালিয়ে একের পর এক চলতে থাকলো ক্যামেরার ক্লিক।

সাদা বড় বকগুলো অনেকটা নির্ভয়। যেন ছবির পোজ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কত অঙ্গভঙ্গি তাদের! কেউ লম্বা মাথাটা পালকে গুঁজে দেয় তো কেউ দাঁড়িয়ে যায় এক পায়ে। আবার ঝগড়া করতেও ওস্তাদ তারা। একটু অপেক্ষা করলে দেখতে পাবেন অনেক ঝগড়া।
 
নাহ! আবার একটি বেগুনি কালেম! মনে হলো ধরে একটু আদর মেখে দেই। নিজের পাখার সঙ্গে খুনসুঁটি করছিলো সে।
 
একটু দূরে কচুরিপানা। তার উপর আবার বসে সাইবেরিয়া থেকে আসা মেটে মাথা টিটি। প্রতিটা মুহূর্ত যেন আমাদের জন্ম দিচ্ছিলো নতুন আবেগ, ভালোলাগা, প্রিয়তা।
 
পড়ন্ত বিকেলে শুরু হলো পাখিদের ঘরে ফেরার পালা। সাইবেরিয়া, রাশিয়া, তিব্বত,শ্রীলঙ্কা থেকে আসা পরিযায়ী পাখিরাও ফেরে তাদের অস্থায়ী ঘরে।

মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো কয়েকটি দল। আমাদের যেন বার্তা দিয়ে গেলো এবার ঘরে ফেরো তোমরাও। গোধূলি আলোয় ফিরলাম কিনারে।
 
কানে তখনো পাখিদের ডানা ঝাপটার শব্দ, ক্যা, কু, কিচিক কিচিক, চ্যাক, চ্যাক, খ্যা খ্যা, চুক, চুক,পিক-প্যাক পাখির বুলি। এরমধ্যেই হঠাৎ উদয় হলো এক মেছো বাঘ। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডেই পগার পার।
 
চোখে-মুখে যখন একরাশ মুগ্ধতা, তখন বিমুগ্ধ করলো বাইক্কা বিলের কিনারজুড়ে লাগানো হিজল-তমালগাছ। সন্ধ্যা নেমেছে তখন। শালিক, সুইচোরা, পেঁচাদের নীড় এটা। কিচির-মিচির শব্দে কয়েক হাজার পাখি সেখানে। সে গান শুধু চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনুভব করার।

‘সব পাখি ঘরে ফেরে… ’  সে ঘরে ফেরার গল্পছবি আরেকদিন।
 
বাইক্কা বিলে প্রবেশ: প্রবেশ মূল্য ৫ টাকা। দর্শনার্থী টাওয়ারে ওঠা জনপ্রতি ২০ টাকা। আর নৌকা চড়ার জন্য আপনাকে দিতে হবে ঘণ্টাপ্রতি ৬০ টাকা।

সতর্কতা: মনের ভুলেও পাখিদের ডিসটার্ব করবেন না। বাইক্কা বিল মাছের অভয়ারণ্য বলেই পাখিরা নিরাপদে নিরিবিলি থাকে। ঢিল ছুড়বেন না, কিছু খেয়ে ফেলবেন না জলে। অযথা চিৎকার করবেন না। এতে পাখিদের সমস্যা হয়।

যাতায়াত: ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলে বাসভাড়া ৩৮০ টাকা থেকে শুরু। সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা, আসতে পারেন ট্রেনেও। তবে সময় একঘণ্টা বেশি লাগতে পারে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে বাইক্কা বিলের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। শেষ আট কিলোমিটার রাস্তা মেঠোপথ। শহর থেকে সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ করলে ভাড়া নেবে ১০০০-১৫০০ পর্যন্ত। শুধু যাওয়া ৪০০ থেকে ৭০০। তবে যাওয়ার আগে খাবার নিতে ভুলবেন না। কারণ সেখানে খাবার পাবেন না।

থাকার জন্য রয়েছে বেশিকিছু হোটেল। ভাড়া হোটেল ভেদে ৩০০ থেকে ৪০০০ টাকা। রয়েছে পাঁচতারকা হোটেলও। তবে শহরের হোটেলগুলোতে হাওরের টাটকা দেশি মাছ খেতে ভুলবেন না।

বাংলানিউজের খবরে বাইক্কা বিলে বাঁধ আটকাচ্ছে মৎস্য বিভাগ
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad