ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

উড়িরচরে আতঙ্ক, নিয়ন্ত্রণে দস্যু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪
উড়িরচরে আতঙ্ক, নিয়ন্ত্রণে দস্যু

চর এলাহী, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী  ঘুরে এসে: নাম শুনতেই আতঙ্ক। সব মানুষ জিম্মি দস্যু বাহিনীর হাতে।

আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় কখনো দস্যুদের শাসন বদলালেও সাধারণ মানুষের জীবনের গতি বদলায় না।

ঘর থেকে বের হওয়া, হাটবাজার করা, জমিতে চাষাবাদ করা, সবই চলে দস্যুদের নিয়ম মেনে। এমনকি পুরুষদের বের করে দিয়ে ভূমিহীনের ঘরে রাত কাটায় দস্যুরা। এর বিরুদ্ধে টু-শব্দটি করার সাহস নেই কারও।

আতঙ্ক ছড়ানো এ জনপদের নাম উড়িরচর। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। এখানে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কেউই এখানে যেতে পারে না। চরের বাসিন্দারা ভোটার হতে পারে না। শিশুরা পায়না টিকা, যেতে পারে না স্কুলে, একটা ভিজিডি-ভিজিএফ কার্ডও সেখানে যায় না।

উড়িরচর হচ্ছে চর এলাহী ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। তবে এলাকার আয়তন ও লোকসংখ্যা প্রায় একটি ইউনিয়নের সমান। প্রায় দশ হাজার লোকের মধ্যে এখানে ভোটার আছে দুই শ। ভোটার হয়ে নাগরিক অধিকার চাইবে বলে দস্যু বাহিনী এলাকার লোকদের ভোটার হতে দেয় না। ভোটার করার সময় দস্যু বাহিনী মাইকিং করে ভোটার না হওয়ার নির্দেশ দেয়। বেশ কটি চর নিয়ে গঠিত এ ভূখন্ডে জমি আছে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর।

সরেজমিনে এলাকা ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পারে, উড়িরচরের আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে আশপাশের এলাকায়। পারতপক্ষে এ শব্দটি এলাকার মানুষ মুখেই আনতে চায় না। বাইরে থেকে আসা নতুন কেউ এ চরে যেতে পারে না।

দস্যুদের নিজস্ব গোয়েন্দা আছে নদীর এপার অবধি। চর এলাহীর ক্লোজার ঘাট থেকে ট্রলারে বামনী নদী পার হয়ে ওপারে উড়িরচর যেতে হয়। কিন্তু ক্লোজার ঘাটেই দস্যুদের বিশেষ নজরদারি আছে। বাইরে থেকে আসা নতুন কেউ ট্রলারে উঠলেই খবর পৌঁছে যায় দস্যু বাহিনীর কাছে।

সূত্র বলছে, দস্যুদের ভয়ে উড়িরচরের উন্নয়ন থেমে থাকে। নোয়াখালী পুলিশ সুপারের উদ্যোগে ২০১৩ সালে উড়িরচরের জনতা বাজারে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুলিশ সুপার নিজেই সেখানে গিয়েছিলেন।

কোম্পানীগঞ্জ থানা ইনচার্জ ২৬ সদস্যের পুলিশ দল সেখানে রেখে আসেন। কিন্তু তারা চলে আসার পরই দস্যুরা পুলিশ সদস্যদের মারধর করে। ফলে উড়িরচরে পুলিশ পাহারা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

চর এলাহী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন জানান, ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে উড়িরচরে একটি সাইক্লোন শেলটার নির্মাণের টেন্ডার আহবান করা হয়। কিন্তু দস্যুদের ভয়ে কোনো ঠিকাদার টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেনি।

২০১০-১১ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ এবং ইউনিয়ন পরিষদের তহবিল থেকে উড়িরচরে ৭৫ ফুট দীর্ঘ ও ২৭ ফুট প্রস্থ একটি সেমি পাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন করা হয়। দস্যুরা টিনের চালা খুলে নেয় এবং দরজা-জানালা ভেঙে ফেলে।

চারবাসী কয়েকজনের সঙ্গে বাংলানিউজের কথা হয় মুঠোফোনে। তারা জানান, দস্যুদের দাপটের কারণে উড়িরচরে সরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ডের ছোঁয়া লাগছে না। নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ বিক্রি হয় মুদি দোকানে।

সবে ২ থেকে ৩ জন গ্রাম্য ডাক্তার সেখানকার মানুষের ভরসা। জটিল সমস্যায় এখানকার মানুষ প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কোম্পানীগঞ্জ সদর বসুরহাটে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায়। চরের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না।

চরবাসীর অভিযোগ, চরের জমি চাষাবাদ থেকে ধানকাটা অবধি প্রতিটি পর্বে দস্যুদের চাঁদা দিতে হয়। চাষাবাদ মৌসুমে প্রতি একরে ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। ধান কাটার সময় প্রতি একরে দিতে হয় আরও ৫ হাজার টাকা। এরপরও ধান মাড়াই করে এপারে নিয়ে আসার সময় ধান লুট করে নিয়ে যায় দস্যুরা।

সূত্র বলছে, দস্যুদের নির্যাতনের অনেক খবর চরের বাইরের কেউ জানতে পারেন না। দস্যুদের ইচ্ছায় চলতে হয় চরের সব মানুষকে। দস্যুরা কখনো জোর করে ঘরের পুরুষদের বের করে দিয়ে ভূমিহীন পরিবারের নারীদের সঙ্গে রাত কাটায়। এর বিরুদ্ধে কারও কথা বলার সাহস নেই। চরে বসবাস করতে হলে দস্যুদের অন্যায় আপত্তিও শুনতে হয়।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে উড়িরচর ইব্রাহিম মাঝি ও শাহাদাত হোসেন জাসু বাহিনীর দখলে আছে। বিচার-সালিশ থেকে শুরু করে সব কিছু এরাই নিয়ন্ত্রণ করে।

এ বাহিনীর বিপরীতে আছে খায়রুল আলম গ্রুপ। তার বাড়ি সন্দ্বীপের কালাপানিয়া । তাকে মেরে ফেলে হারিছ বাহিনীর লোক চর দখল করে। হারিস মারা গেলে তার ভাই জাভেদ চরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর আবার খায়রুল আলমের ছেলে মাকসুদুল আলম খোকা চরে আধিপত্য বিস্তার করে। খোকাকে হটিয়ে চরের দখলে যায় বর্তমান ইব্রাহিম ও জাসু বাহিনী।

দস্যুদের তৎপরতা প্রসঙ্গে কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ সাজেদুর রহমান (সাজিদ) বাংলানিউজকে বলেন, উড়িরচরের দস্যু দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে। অভিযানে দস্যুদের গ্রেপ্তার করা হলেও তদবির করে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।

মূলত যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে সেখানে নিবিড় নজরদারি রাখা সম্ভব হয় না। খবর পেয়ে পুলিশের সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে পৌঁছাতে পারে না। উড়িরচরে পুলিশ ফাঁড়ি ও যানবাহনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।