ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

জলবায়ু পরিবর্তন, ঝুঁকিতে জেলেরা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৪
জলবায়ু পরিবর্তন, ঝুঁকিতে জেলেরা

টাংকিঘাট, (বয়ারচর, হাতিয়া) নোয়াখালী ঘুরে এসে: বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এ পরিবর্তনে তাদের জীবিকা সরাসরি হুমকির মুখোমুখি।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙন, নদীতে মাছ কমে যাওয়া ছাড়াও নানামুখী কারণে বহু জেলে এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এ পেশা জেলেদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। বিকল্প জীবিকা কিংবা এদের নিরাপত্তায় বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বয়ারচরের টাংকিঘাট। মেঘনার তীরে ঝড়ের প্রলয়ে বিক্ষুব্ধ জনপদে শত শত জেলের বসবাস। মেঘনা নদী আর সমুদ্রে জাল ফেলা, জালে ওঠা মাছ বাজারে বিক্রি এভাবেই চলে নিত্যদিনের জীবিকা। পরিবার পরিজন নিয়ে বছরের পর বছর তারা এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছে। সেই জীবিকায় এখন নানামুখী সংকটের সম্মুখীন।

বয়ারচর হাতিয়া বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে টাংকিঘাট। মেঘনা থেকে ছোট্ট খাল ঢুকেছে ঘাটের কিনার ঘেঁসে। পড়ন্ত বিকালে মাছধরা নৌকাগুলো খালে ভেতরে অলস পড়ে আছে। জেলেরা এ সময় জাল মেরামত ছাড়াও দরকারি কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন। এখানেই বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হলো বেশ কজন জেলের।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকার ধরন বদলে যাওয়ার কথা তুলে ধরে জেলে মো. ইউসুফ আলী জানালেন, ঝড়-বন্যায় এখন আর নদীতে বেশি সময় মাছ ধরা যায় না। ঝড়ের সিগন্যাল পেলে মাছধরা ফেলে কিনারে চলে আসতে হয়। আবার কখনো কখনো নিম্নচাপের সংকেত আছে বলে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে যাওয়া সম্ভব হয় না।

আরেকজন মোহাম্মদ আলী। জানালেন, ঝড়-জলোচ্ছাসে নদীর পাড়ে বাসবাসকারী এ জেলের জীবন ওলট-পালট করে দেয়। বাড়িঘরে পানি ওঠে। প্রবল বাতাসে ঘর উড়িয়ে নেয়। তখন মাছধরা তো দূরের কথা, ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ছুটতে হয়। তা ছাড়া নদীতে মাছও আগের তুলনায় অনেক কম।

সরেজমিনে জেলেদের সঙ্গে আলাপে বাংলানিউজ জানতে পারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মাছধরার ওপর নির্ভরশীল এ পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত তাদের অবস্থান বদল করছে। কখনো নদীর ভাঙনে, আবার কখনো ঘূর্নিঝড়ের তান্ডবে এদেরকে বাড়িছাড়া হতে হয়। নদীর তীরে বসবাসকারী অধিকাংশ জেলে পরিবার বছরে একাধিকবার বসতি বদলাতে বাধ্য হয়।

নদীর পাড়ের এসব জেলেদের বক্তব্যের সমর্থন দেয় গবেষণা তথ্য। একাধিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সূত্র বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জেলেদের জীবিকার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। দুর্যোগ এবং নদীতে মাছের অপ্রতুলতার কারণে জেলেরা উপার্জনে অক্ষম হয়ে পড়ে।

অনেক সময় ঝড়ের কবলে পড়ে জাল-নৌকা সবই হারিয়ে ফেলে তারা। অথচ অনেকে এ জাল-নৌকা সংগ্রহ করেছেন ধারদেনা করে। ফলে কাঁধে বাড়ছে ঋণের বোঝাও।

স্থানীয় বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রুহুল মতিন বাংলানিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ এলাকার জেলেদের ঝুঁকি প্রতিনিয়তই বাড়ছে। আর এ ঝুঁকি তাদের জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বড় পরিসরে গবেষণার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে এ তথ্যগুলো তুলে আনা প্রয়োজন। এদের পুনর্বাসনে দীর্ঘমেয়াদে উদ্যোগ না নেওয়া হলে ঝুঁকি আরও বাড়বে।  

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ এলাকার জেলেরা নানামুখী সংকট মোকাবেলা করলেও এদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বিশেষ কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। স্বল্প মেয়াদে কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও তা খুবই কম সংখ্যক জেলেকে সহায়তা করতে পেরেছে। তথ্য সংগ্রহকালে জেলেরা ক্ষেভের সঙ্গে বলছিলেন, আর কত ফটো তুলবেন। আমরা তো আর জীবন চালিয়ে নিতে পারছি না।

টাংকিঘাটের জেলের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, এনজিও উদ্যোগে এখানে জেলেদের সংগঠিত করে কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে তা একেবারেই সীমিত। এসব উদ্যোগের মধ্যে সাগরিক সমাজ উন্নয়ন সংস্থার একটি উদ্যোগ আছে।

ওই সংস্থার অধীনে ‘নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলার উপকূলীয় এবং চর অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন’ শীর্ষক প্রকল্পের একটি মৎস্যজীবী দল আছে টাংকিঘাটে। এদের সদস্য সংখ্যা ১০ জন।                   

মৎস্যজীবী দলের সদস্যভুক্ত জেলেদের তথ্যমতে, জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে এদের বসতবাড়ি উঁচু করতে এ প্রকল্প থেকে সহায়তা করা হয়েছে। অনেক জেলেদের ভিড়ে একজন বলছিলেন, আমাদের নৌকায় রেডিও ছিল না। এ কারণে আগে নিম্নচাপের খবর পেতাম না এখন এ প্রকল্প থেকে রেডিও দিয়েছে। আবহাওয়ার সব বার্তা যথাসময়ে পাচ্ছি।

জেলেদের মাছ ধরায় সহায়তা হিসেবে টাংকিঘাটের মৎস্যজীবী দলের সদস্যরা লাইফ জ্যাকেট ও বয়া পেয়েছেন। এগুলো নিয়ে এখন তারা নির্ভয়ে মাছ ধরতে যেতে পারছেন। এ সদস্যদের জেলে পরিচত্রপত্র দেওয়া হয়েছে। বিকল্প আয়ের উৎস্য খুঁজে পেতে প্রশিক্ষণের সঙ্গে গাছের চারা ও মুরগি দেওয়া হয়।

জেলেরা মনে করেন, অল্প কজন জেলে নিয়ে এটা খুবই ক্ষুদ্র সহায়তা। তবে এটা দৃষ্টান্ত। এমন কাজ সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। বিকল্প আয় ছাড়াও প্রশিক্ষণভিত্তিক আরও কিছু প্রকল্প নেওয়া দরকার। যাতে জেলেরা ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে।

নোয়াখালীর হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জের নদী ও সমুদ্রতীরের বহু জেলে জানাচ্ছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনে তাদের জীবনযাত্রা বদলে যাওয়ার কাহিনী। প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের ভেতরে সময় পার করছেন তারা। ভবিষ্যতে বড় সংকটের শঙ্কা তাদের প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।