ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

পাহাড়ি দৈত্যাকার মাশরুম ‘ঢোলের বাড়ি ওল’

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৪
পাহাড়ি দৈত্যাকার মাশরুম ‘ঢোলের বাড়ি ওল’

‘ঢোলের বাড়ি ওল’ নামে পাহাড়ি দৈত্যাকার মাশরুম পাওয়া গিয়েছিল রাঙামাটি শহরের খুব কাছের আসামবস্তিতে। মোটামুটি দৈত্যাকার হলেও তারা এটা খায়।

বাজারে বিক্রিও করে। অন্যদিকে শহর থেকে অনেকটা দূরে বালুখালি বা তারও দূরের মানুষ আরো বৃহদাকার মাশরুম ‘দেবেদা ওলকে’  কবর দিচ্ছে, পূজা করছে!
আদিবাসীরা বন্য মাশরুম পছন্দ করলেও গোষ্ঠীভেদে তাদের জ্ঞান বৈচিত্র্যময়। মাশরুমের ব্যাপারে বিভিন্ন আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী লোকজজ্ঞান অনুসন্ধান করতে গিয়ে মিলেছে মজার সব তথ্য।

আমাদের পাহাড়ি আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম প্রিয় খাবার পাহাড়ি ওল। তুচ্ছার্থে আমাদের ব্যাঙের ছাতা পাহাড়ি জনপদে ওল বলে কথিত। ভারতে হিন্দি ভাষায় একে কুম্ভী বলা হয়। আমাদের ব্যাঙের ছাতার মতো তুচ্ছার্থের প্রয়োগ প্রতিবেশী ভারতেও আছে, যেমন হরিয়ানা রাজ্যের মানুষ একে বলে ‘সাপ কি ছাতা’।

পাহাড়ি আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী মাশরুমকে ওল এবং খাবার অযোগ্য মাশরুমকে বিষওল বলে। আজ আমার আলোচ্য বিষয় বিষওল নয়, খাবার যোগ্য পুষ্টিকর সুস্বাদু দু’টি দৈত্যাকার মাশরুম।

মাশরুম বলতে আমরা যা দেখি তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী ফুল বা ফলের মতো অঙ্গ। যার ফুল বা ফল হয় তার দেহ কাঠামো কই? আমরা জানি এর দেহকাঠামো আণুবীক্ষণিক সূত্রাকার মাইসেলিয়াম দিয়ে গঠিত। সবুজ বৃক্ষরাজি যেমন বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফুল-ফল দেয়, তেমনি দৃষ্টির অগোচরে বেড়ে উঠতে থাকা মাশরুম মাইসেলিয়াম সারা বছর ধরে পুষ্টিলাভ করে একটি নির্দিস্ট মৌসুমে স্পোরোফোর বা মাশরুমের ফলদেহ উৎপন্ন করে। আমরা এর শুধু স্পোরোফোর বা ফলদেহটিই দেখতে পাই। তাই মাশরুম খুব ক্ষণস্থায়ী প্রতিবেশী। পরিবেশের এই ক্ষণস্থায়ী দৃস্টিনন্দন উপাদান অনেক ক্ষেত্রেই খাদ্যমান সমৃদ্ধ হওয়ায় এর চাহিদা আকাশচুম্বী। সম্প্রতি এসব মাশরুমের বাজার পরিচিতি বেড়ে গেছে। বিক্রি হচ্ছে আবাদ করা মাশরুমের চেয়ে চার/পাঁচ গুণ বেশি দামে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগৃহীত সবচেয়ে বৃহদাকার মাশরুম হিসেবে ঢোলের বাড়ি ওল (Drum Stick Mushroom) উল্লেখযোগ্য। ঢোল বাজানোর জন্য যে কাঠি ব্যবহার করা হয় এ মাশরুম অনেকটাই সেরকম। ঢোলের বাড়ি ওলের বৈজ্ঞানিক নাম Drum Stick Mushroom (R. Heim) Pegler & Lodge. ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত এর বৈজ্ঞানিক নাম ছিল Tricholoma lobayensis Heim. কেননা সিঙার (১৯৮৬) বনের উদ্ভিদের শেকড়ের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাক্টোমাইকোরাইজাল সম্পর্কযুক্ত এবং  যাদের হাইফিতে ক্ল্যাম্প কানেকশন নেই এমন মাশরুমের গণ হিসেবে Tricholoma কে প্রস্তাব করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ডেভিড এন পেগলার ও তার দু’জন সহকর্মী এদের অঙ্গসংস্থান বাস্তুসংস্থান এবং রাইবোজোমাল ডি এন এ চরিত্র বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে সাতটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাশরুমকে Tricholoma গণ থেকে আলাদা করে Macrocybe নামে নতুন গণের প্রস্তাব করেন যারা অবশ্যই নন-মাইকোরাইজাল এবং যাদের হাইফাগুলোতে অসংখ্য ক্ল্যাম্প কানেকশন উপস্থিত।

সম্প্রতি রাঙামাটির পার্বত্য অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ঢোলের বাড়ি ওল বলে কথিত এই মাশরুম কাঠের গুঁড়া ও গমের ভুষির প্রচলিত মিশ্রণের প্যাকেটে ল্যাবে স্পন রান শেষে নীল পলিথিন নির্মিত গ্রিন হাউজের মাটিতে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। উৎপাদিত মাশরুমের আকৃতি প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাশরুমের আকৃতির এক চতুর্থাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ হয়েছিল। প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতে গিয়ে সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশে মাশরুম তার সম্পূর্ণ জিনগত সম্ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। জিনগত সম্ভাবনা থাকায় এই জনপ্রিয় মাশরুমকে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন প্রকার কৃষি বর্জ্য জাতীয় উপকরণ এবং তাদের বিভিন্ন সংমিশ্রণে আবাদ করার সুযোগ আছে।

এই মাশরুমের স্টাইপ বা ছাতার দণ্ড কেন্দ্র বরাবর অবস্থিত, লম্বায় ৫-৩০ সে.মি. ও প্রস্থে ১.৫-৬ সে.মি পর্যন্ত হয়। সাদা, মসৃণ ত্বকযুক্ত, স্পোর প্রিন্ট সাদা, স্পোর ডিম্বাকার, মসৃণ, ৫.৫-৬.৫ ৩.৫-৪.৩ মাইক্রোন। কুঁড়ি অবস্থায় এটি গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠে। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশের চেয়ে আধা প্রাকৃতিক ছায়াযুক্ত বা কোটরগত পরিবেশে এর প্রাইমর্ডিয়া ও মাশরুম ফ্রুটবডির সংখ্যা অনেক বেশি। সম্ভবত এটিও মাশরুমের বেসিডিউম সাইজ বা আকৃতি হ্রাসের কারণ হতে পারে। কারণ আমরা সবুজ উদ্ভিদে ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেখতে পাই ফলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ফলের আকৃতি হ্রাস পায়। কাঁচা এই মাশরুমটি কওমারিন গন্ধযুক্ত, হালকা ঝাঁজালো ওকাজু বাদাম স্বাদযুক্ত। তবে রান্না করলে সুস্বাদু। পাহাড়ি আদিবাসীদের কাছ থেকে এটি পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে।

একই গণভুক্ত এদেশের তথা এশিয়ার  সবচেয়ে বৃহদাকার মাশরুমের নাম gigantea (Massee) Pegler & Lodge. একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রাঙামাটির বালুখালি অঞ্চলে আদিবাসীদের বসতবাড়ির পাশে একসাথে গুচ্ছাকারে বেড়ে ওঠে এই মাশরুম। এত দৈত্যাকার মাশরুম তারা এ জীবনে আর দেখেনি। গ্রাম প্রধানসহ সবাই সিদ্ধান্ত নেয় এই মাশরুম তারা খাবে না, কেননা এটি দেবতাদের পাঠানো কোনো বিশেষ উপহার যা নিছক উদরপূর্তিতে ব্যবহার করা যাবে না। তারা সবাই মিলে সেই অতিকায় দৈত্যাকার মাশরুমকে সমাধিস্থ করে সমাধির পরিসীমা বরাবর বসে চোখের জলে দেবতার প্রশস্তি পাঠ করে। খুব কষ্ট নিয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে হয় আবার কবে কখন ফুটে এই দৈত্যাকার মাশরুম!

দীর্ঘ দু’বছর পর গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে জানা যায়, বালুখালিতে পুরনো মৃত আম গাছের গুঁড়ির কাছাকাছি মাটিতে মাশরুমটি জন্মে। খবর পাওয়া মাত্র চলে যাই সেই আদিবাসী  ত্রিপুরা পরিবারের কাছে। পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে যাওয়ায় ভালোই হলো। কেননা আদিবাসীদের পারিবারিক অনুশাসন মাতৃতান্ত্রিক এবং তারা খুব প্রাণখুলে আমাদের সাথে ভাব বিনিময় করলো। তাদের জানার খুব কৌতূহল হলো, আমরা কি মাশরুমটি খেতে পারব?

খুব যত্ন সহকারে ঢাকার সাভারে আমার ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরিতে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা প্রফেসর এস টি চ্যাঙ-এর সুপারিশ করা বিশেষ পি.ডি.এ মিডিয়ায় টিস্যু কালচার করা হলো। আণুবীক্ষণিক অঙ্গসংস্থান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ফাইটোকেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে এর ফাইটোকেমিক্যাল স্ক্রিনিংয়ের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রথমে অল্প করে এবং পরে বেশ কিছুটা অংশের রান্না-খাওয়ার কাজটিও শেষ করেছি।

আসলে একটু সাহসী না হলে বন্য সুস্বাদু মাশরুম খাওয়া যায় না। আর সাহস বাড়ানোর জন্য খুব ভালো কাজ হচ্ছে মূলত বিষাক্ত মাশরুমগুলো সম্পর্কে ভালো করে পড়াশোনা করা। কেননা হাজার হাজার জাতের মাশরুম সম্পর্কে জানার চেয়ে হাতে গোনা কয়েকটি বিষাক্ত মাশরুম সম্পর্কে জানাটাই শ্রেয়। এছাড়া শনাক্ত করা মাশরুমটির গণের নামটি জানতে পারলেই কাজটি আরো সহজ হয়ে যায়।

যে মাশরুম নিয়ে এত গল্প তার আঞ্চলিক নাম খুব মজার। দেবতাদের পাঠানো বলে এর নাম দেবেদা ওল, শিক্ষিত পাহাড়ি আদিবাসী ও বাঙালি মাশরুমটির আকৃতির জন্য দৈত্যাকার শব্দটি উচ্চারণ করলেও আমি অতি সাধারণ আদিবাসীদের মতো  একে দেবেদা ওল বলতে চাই- দেবেদা ওল অর্থাৎ দেবতার মাশরুম। দেবেদা ওলের পাইলিয়াস ( ছাতা ) প্রাইমর্ডিয়া বা কুঁড়ি অবস্থায় সাদা পরে ক্রমশ ধূসর-সাদা রং ধারণ করে যার ব্যাস ১০-৩০ সে.মি. যা প্রথমে উত্তলাকার পরে প্রায় সমান্তরাল, মসৃণ ত্বকযুক্ত, কিনারা অবিভক্ত এবং বাকানো।

ঢোলের বাড়ি ওলের মতো দেবেদা ওলের গল্পটি চাষ-বাস দিয়ে শেষ করা গেল না। কারণ এটি এখনো আমার মাশরুম ল্যাবরেটরিতে কখনো টেস্টটিউবে, কখনো কাঠের গুঁড়া এবং গমের ভুষি দিয়ে প্রস্তুত করা স্পন প্যাকেটে উপনিবেশ গড়ে তুলছে। সে কি শুধু শুধুই মাইসেলিয়াল উপনিবেশ করবে, সে কি সামনে গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফুটে উঠবে না আমার গ্রিন-হাউজে? আমি এর ফলন পাওয়ার আশাবাদী। কেননা আমি এর ভাষা বুঝতে পারছি।  
এই মাশরুমের শনাক্তকরণ নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীর মতানৈক্য আছে। তবে বর্তমানে যেটি দরকার সেটি হলো সবাই মিলে একসাথে কাজে ঝাপিয়ে পড়া।

লেখক: পিএইচডি  গবেষক, মাইকোলজি অ্যান্ড প্ল্যান্ট প্যাথললি ল্যাবরেটরি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষক, জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কেন্দ্র, সোবহানবাগ, সাভার, ঢাকা।          

পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য পাতায় লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।