ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

তথ্যকেন্দ্র এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাতিঘর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৪
তথ্যকেন্দ্র এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাতিঘর

নোয়াখালীর সুবর্ণচর ঘুরে এসে: প্রত্যন্ত এলাকায় জীবিকার পথ দেখাচ্ছে তথ্যসেবা কেন্দ্র। তথ্য আদান-প্রদান আর সেবামূলক কার্যক্রমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তরুণ সমাজ দুনিয়া জোড়া নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে।

সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রত্যন্ত তরুণ সমাজের কাছেও দ্রুতই পৌঁছে যাচ্ছে। ইন্টারনেট প্রতিনিয়তই সহজ করে দিচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। একই সঙ্গে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে উদ্যোক্তাদের আয়-রোজগার বাড়ছে দিন দিন।

এক কথায় বলতে গেলে শূন্য থেকেই শুরু। সম্বল মাত্র একটি কম্পিউটার আর দু’খানা চেয়ার-টেবিল। এগুলো নিয়েই চরবাটা ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রের কাজ শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলাম। এটি উপকূল জেলা নোয়াখালীর সুবর্ণচরের একটি ইউনিয়ন। পরিষদ ভবনের বাইরে পুরোনো ভবনের একটি কক্ষে তথ্যসেবা কেন্দ্রের কাজ চলে। সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ।

সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজের চোখে পড়ে, সুবর্ণচরের চরবাটায় তথ্য আদান-প্রদান আর প্রযুক্তি সেবার সব কাজই উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলামকে ঘিরে। শুধু চরবাটা ইউনিয়ন নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও বহু লোকজন তার কাছেই ছুটে আসেন।

প্রতিদিনের চাকরির বিজ্ঞাপন, ভর্তির তথ্যাবলী জানা, কোথাও অনলাইনে আবেদন পাঠানো, ছবি স্ক্যান করা এমনকি বিমানের টিকেট বুকিংয়ের জন্য লোকজন এখানেই ছুটে আসেন।

তথ্যকেন্দ্রটাই যেন এলাকার বাতিঘর।

তথ্যসেবা কেন্দ্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অন্তত ৮০ শতাংশ সফল বলে দাবি জোবায়ের ইসলামের। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এলাকার মানুষ যেসব কাজের জন্য আগে ৩৫ কিলোমিটার দূরের জেলা সদরে যেতেন, সে কাজ এখন এখানে বসেই সমাধান হয়ে যায়।

বিমানের টিকিটের জন্য এখানে লোকজন আসেন। কৃষি বিষয়ক তথ্যের জন্য কৃষকেরা আসেন। ছাত্ররা ভর্তির খোঁজ-খবরের জন্য অসেন। পরীক্ষার ফল জানা, বিসিএস পরীক্ষার আবেদন করার জন্যও এখানে অনেকেই আসেন। অনেক ক্ষেত্রে কোনো সেবাব্যয় নেওয়া হয় না।

তথ্যকেন্দ্রে আসা একজন জানালেন, এলাকায় জলদস্যুদের তৎপরতা সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ মহলকে কিছুতেই জানাতে পারছিলাম না। অবশেষে তথ্যকেন্দ্রে এসে ই-মেইলে আবেদন পাঠালাম। আবেদন পেয়েই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দস্যুদের তৎপরতা কমেছে। তথ্য-প্রযুক্তির সেবা নিয়ে সফল হওয়া এমন আরও অনেক গল্প আছে।

শুরুর প্রসঙ্গ তুলে উদ্যোক্তা ও মাস্টার ট্রেইনার জোবায়ের ইসলাম বাংলানিউজকে বললেন, এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। স্থানীয় পর্যায়ে ছোটোখাট কম্পিউটারের ব্যবসার অভিজ্ঞতা ছিল তার। একদিন চরবাটা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব তাকে প্রস্তাব দেন তথ্যকেন্দ্রটি পরিচালনার।

নিজের ব্যবসা সচল রেখেই জোবায়ের ইসলাম এখানে কাজ শুরু করেন। খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। কঠোর পরিশ্রমে মাত্র এক মাসের মাথায় তথ্যকেন্দ্রে ভালো ফল পাওয়ায় আগের ব্যবসাটি ছেড়ে দেন জোবায়ের। এখানেই দিনে দিনে তার রোজগার বাড়তে থাকে।

তথ্যকেন্দ্রের কাজের সফলতা দেখে ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ থেকে জোবায়ের ইসলামকে কারিগরি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে বলা হয়। আবেদন করা হলে বোর্ড থেকে পরিদর্শন করে অনুমোদন দেওয়া হয়।

কারিগরি বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার ফলে এ তথ্যকেন্দ্র ‘অফিস অ্যাপ্লিকেশন’ ও ‘ডাটাবেজ’ নামের দু’টি প্রোগ্রাম নিয়ে তিন ও ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ শুরু করে। এ সময়ে কম্পিউটার কেনার জন্য কিছু অর্থেরও প্রয়োজন পড়ে যায়।

এনজিও থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এর সঙ্গে নিজের কিছু টাকা জুগিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগ নিয়ে তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন জোবায়ের। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল করছেন।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রথম সেশনে ‘অফিস অ্যাপ্লিকেশন’ প্রোগ্রামে পরীক্ষা দেন ২৬ জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ১৮ জন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় সেশনে ৩০ জন পরীক্ষা দিয়ে ২৬ জন জিপিএ-৫ এবং চারজন জিপিএ পেয়েছেন। জুলাই-ডিসেম্বর সেশনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮১ জন।

সূত্র বলছে, তথ্যসেবা কেন্দ্রে খরচ বাদে মাসিক আয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। কাজের সুবিধার্থে জোবায়ের ইসলাম এ কেন্দ্রে বেশ কজন উদ্যোক্তা তৈরি করেছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন জোবায়ের ইসলাম ও সালমা খানম এবং বিকল্প উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন রাশেদা আক্তার সুরাইয়া ও বিশ্বজিৎ চন্দ্র দাস। তারা এ কেন্দ্রেই কাজ শিখেছেন। তারাও এখন মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন।

এরই মধ্যে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে চরবাটা ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র বেশ কটি পুরস্কার অর্জন করেছে। ২০১১ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা উদ্যোক্তা নির্বাচিত হয়েছেন জোবায়ের ইসলাম। একই বছর উপজেলা ও জেলা পর্যায়েও শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পান। ছয় মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণে ভালো ফল করায় ২০১২ সালে পেয়েছেন কারিগরি বোর্ডের পুরস্কার।

উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলাম জানান, বিদ্যু‍তের সংকট, ইন্টারনেটে ধীরগতি আর স্থান সংকটই এখানকার প্রধান সমস্যা। চরবাটা ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব ভবন না থাকায় তথ্যকেন্দ্রের কাজ চলছে চরবাটার খাসেরহাট বাজারের একটি ভবনের কক্ষে। বেশি লোকজন এলে বসারও জায়গা হয় না। প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীরা বসতে পারেন না।

এসব সমস্যার ভেতর দিয়ে কাজ চালিয়েও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেছেন উদ্যোক্তা জোবায়ের। নেটওয়ার্ক ভালো পেলে ৫০০ ছেলেমেয়ের বেকারত্ব দূর করার পরিকল্পনা আছে তার। স্থান সংকট দূর হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেবেন। ইন্টারনেট সুবিধা আরও ছড়িয়ে দিতে একটি সাইবার ক্যাফে তৈরির পরিকল্পনাও আছে তার।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।